এভাবে কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার নহল চৌমহনী গ্রামের সাহেব আলীর ছেলে পত্রিকার হকার আব্দুর রহিম।
রহিম বলেন, ‘পরিবারের জন্য শেষ কবে মাছ ও গোস্ত কিনেছি তা মনে নেই। এই নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ না থাকলেও যখন ছেলে-মেয়েরা ভাত দিলে মাছের জন্য কান্না করে তখন আর সহ্য হয় না। ছোট বাচ্চাটার বয়স দুই বছর। ১০ মাসের মধ্যে একদিনও একপোয়া দুধ কিনে দিতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘ঘুমের মধ্যেই কল্পনায় থাকি, কখন জানি ভোর হয়ে পত্রিকার গাড়ি চলে যায়। সময়মতো স্টেশনে পৌঁছাতে না পারলে গাড়ি চলে যাবে। একবার গাড়ি মিস হলে পত্রিকা চলে যায় কসবার কোটি চৌমহনী।’
আরও পড়ুন: সব উপজেলায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয় হবে: মন্ত্রী
তাই কাকডাকা ভোর হতে না হাতেই পত্রিকার জন্য পান্নারপলু স্টেশন গিয়ে সুগন্ধা গাড়ির অপেক্ষায় বসে থাকেন। পত্রিকা নামিয়ে সাইকেলের পেছনে বেঁধে এক হাতে সাইকেল চালান, প্লাস্টিকে মোড়ানো অন্য হাতটি সাইকেলের ওপর ফেলে রাখেন। এই কায়দায় সাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন ৪০ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরে বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ড, জাহাপুর জমিদার বাড়ি, আলীরচর কলেজ, বোরারচর ও কলাকান্দি বাজারে ১৪ বছর ধরে পত্রিকা বিক্রি করছেন আব্দুর রহিম।
এতে তার পরিবারের ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হয়ে যেত। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ হয়েও এরকম কঠিন কাজের সাথে সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। অনেক মানুষের ভালোবাসা আর স্মৃতি জড়িয়ে থাকা এ কাজটি কষ্ট মনে হতো না। এখন পত্রিকা বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রহিমের কষ্টের আর শেষ নেই।
আরও পড়ুন: প্রতি গাছে ৪ মণ কুল, তাক লাগালেন শ্রবণপ্রতিবন্ধী কৃষক
দেশে করোনাভাইরাস হানা দেয়ার পর স্কুল, কলেজ, অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে পত্রিকা বিক্রিও বন্ধ হয়ে গেছে তার। খুচরা পাঠকরাও করোনা ভয়ে পত্রিকা ধরে না। তাদের ধারণা পত্রিকায় ভাইরাস থাকতে পারে।
পত্রিকা বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিগত ১০ মাস একেবারে বেকার বসে দিন কাটছে তার।
দুই মেয়ে ও এক ছেলে আর বৃদ্ধ বাবা-মা নিয়ে রহিমের সংসার। পরিবারের সকলের ভরণ-পোষণ দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। সাদা ভাতের সাথে ডাল দিয়ে খেয়েই দিনগুলো কেটে যাচ্ছে তাদের।
আরও পড়ুন: দেশের ৮৬ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কৃষিতে জড়িত: গবেষণা
রহিম বলেন, ‘পরিবারের জন্য শেষ কবে মাছ ও গোস্ত কিনেছি তা মনে নেই। এই নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ না থাকলেও যখন ছেলে-মেয়েরা ভাত দিলে মাছের জন্য কান্না করে তখন আর সহ্য হয় না। ছোট বাচ্চাটার বয়স দুই বছর। ১০ মাসের মধ্যে একদিনও একপোয়া দুধ কিনে দিতে পারিনি।’
তিনি জানান, করোনার মধ্যে কিছু মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি। যা পেয়েছি তাতে ১০ মাস চলে না। একটি সংসারে কত কিছুইত লাগে। সব আমার নেই। ধার-দেনা করে শুধু জীবনটা বাঁচিয়ে রাখছি। এভাবে আর কয়দিন চলবে। আমি ভিক্ষা করতে শিখিনি। কাজ করে খেতে চাই। কবে যে, করোনা যাবে জানি না।
আরও পড়ুন: প্রতিবন্ধী-বান্ধব ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করার আহ্বান
‘শুনেছি সরকার শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য কত কিছু করে। আমাকে যদি বাঁচার মতো কিছু একটা করে দিত। তাহলে আমি আমার ছেলে-মেয়েগুলো নিয়ে জীবনাটা সাজাতাম। বড় মেয়ে স্থানীয় একটি মাদরাসায় ক্লাস থ্রিতে পড়ে, ছেলেটা ইবতেদায়ি প্রথম শ্রেণিতে, ইচ্ছে একজন আলেম বানানোর, মৃত্যুর পর যেন কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করতে পারে,’ বলেন তিনি।
আরও পড়ুন: প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কোটা সংরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি ইউজিসি’র অনুরোধ