গত ১২৭ বছর ধরে শেরপুরের পালবাড়ি পূজামণ্ডপে জাঁকজমকভাবে পালিত হচ্ছে দুর্গাপূজা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্মের স্বাধীনতা যে বাংলাদেশি মানসিকতায় গভীরভাবে নিহিত রয়েছে তার প্রমাণ পালবাড়ি।
নালিতাবাড়ির ভোগাই নদীর তীরে খালভাঙ্গা এলাকায় পালপাড়ায় শিক্ষাবিদ নগেন্দ্র চন্দ্র পালের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এ দুর্গাপূজাটি। প্রতিবছর পালবাড়ির পারিবারিক পূজা হলেও এটি এখন সর্বজনীন পূজায় পরিণত হয়েছে।
ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বাঙালিয়ানার অন্যন্য নিদর্শন পালবাড়ির পূজামণ্ডপটি শেরপুর জেলার সর্ব প্রাচীন পূজামণ্ডপই নয়, এটি দেশের দ্বিতীয় প্রাচীন পূজামণ্ডপ হিসেবেও পরিচিত।
আরও পড়ুন: দুর্গাপূজা: মৌলভীবাজারে মণ্ডপের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
পালবাড়ির পূজা কমিটির সভাপতি গৌরাঙ্গ চন্দ্র পাল বলেন, ১৮৯৫ সালে পালপাড়ায় আমাদের পূর্বপুরুষ মঙ্গল রাম সরকার পারিবারিকভাবে তৈরি করেন শ্রী শ্রী মঙ্গল ভবন পূজামণ্ডপ। তৈরির পর থেকেই পারিবারিকভাবে চলতে থাকে দুর্গাপূজা। হঠাৎ মঙ্গল রাম সরকার স্বর্গীয় হন। এরপর থেকেই ঐতিহ্যবাহী এ পূজামণ্ডপটির হাল ধরেন তার ছেলে নালিতাবাড়ির শিক্ষাগুরু নগেন্দ্র চন্দ্র পাল।
বছরের পর বছর ধরে পালবাড়িতে দুর্গাপূজা স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। নিছক পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে এটি একটি জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পালবাড়ি পূজাকে একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে দেখেন যেখানে সকল ধর্মের মানুষ সুখ খুঁজে পেতে একত্রিত হয়।
প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে পূজামণ্ডপটি পরিচালনা করেছেন নগেন্দ্র চন্দ্র পাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশত্যাগে বাধ্য হলেও দুর্গাপূজার ব্যত্যয় ঘটেনি। শরণার্থী অবস্থাতেই সীমিত আকারে পালবাড়ির লোকজন দুর্গাপূজা অব্যাহত রেখেছেন।
প্রয়াত নগেন্দ্র পালের ছেলে ব্যাংকার বিশ্বজিৎ পাল বলেন, শতবর্ষী পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ পূজামণ্ডপে আগে থেকেই দুর্গাপূজাকে ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এক সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হয়ে আসছে। কে হিন্দু কে মুসলিম তার বালাই নেই। সকলে মিলে একসঙ্গে দূর্গোৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন।
আরও পড়ুন: শনিবার মহা ষষ্ঠীর মধ্যদিয়ে শুরু হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপূজা
তিনি বলেন, পূজামণ্ডপের সামনে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আরতি ও লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কেবল দুর্গাপূজার ধর্মীয় অনুসঙ্গ থাকেনি, হয়ে উঠেছে সব শ্রেণির মানুষের আনন্দ-বিনোদনের অংশ। আগে এখানে যাত্রাপালা, নাটক মঞ্চস্থ হতো। প্রতিবছর নবমী পূজার দিনে জারি গান, আনন্দ-বিনোদনে এক অপূর্ব মিলনমেলার আবেশ সৃষ্টি হয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা চারপুরুষ ধরে এ দুর্গাপূজাটির আয়োজন করে আসছি। আমাদের পঞ্চম প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। এখন তাদের হাতে আমরা পূজা আয়োজনের ভার ছেড়ে দিতে যাচ্ছি। এই দুর্গাপূজার মধ্য দিয়ে আমরা মানুষকে আনন্দ দিতে চাই। সর্বস্তরের মানুষের মঙ্গল কামনা করি।
স্থানীয় সাংবাদিক বিপ্লব দে কেটু বলেন, স্বাধীনতার পরপরই আমার জন্ম। সেই ছোটকাল থেকে আমি পালবাড়ির পূজা দেখতে আসি। এবারও আসছি। এই পূজা না দেখলে আমাদের মনের সাধ পূর্ণ হয় না। আগে তো নদী পার হয়ে আসতে হতো। কত কষ্ট হয়েছে। তারপরও সবাই এ পালবাড়ির পূজামণ্ডপের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। সেটা মনে এক আলাদা তৃপ্তি এনে দেয়।
এ বছর শেরপুর জেলায় ১৪৪টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপিত হচ্ছে।
এ উপলক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। প্রতিটি পূজামণ্ডপকে সিসি টিভির আওতায় আনা হয়েছে। মোতায়েন রয়েছে পুলিশ, আনসার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, র্যাব-পুলিশের কড়া নজরদারি ও টহল চলছে। স্থানীয়ভাবে প্রতিটি পূজামণ্ডপে পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন।
আরও পড়ুন: দুর্গাপূজা: বাগেরহাটে ৬৪২টি মন্দিরে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি