সন্দ্বীপ ও হাতিয়ার উপকূল ঘেঁষে দ্রুত জেগে উঠা চরের বিশাল অংশজুড়ে জন্ম নেওয়া ‘উরির’ সবুজ সমারোহ দেখে এলাকার মানুষের বুকে নতুন আশা জেগেছে। মেঘনার ভাঙনের কবলে কিংবা হুমকির মুখে যারা অন্যত্র ভাড়ায় কিংবা নতুন ঘর তৈরির চিন্তা ভাবনা করছিলেন তারা অনেকেই পুনরায় ফিরে আসছেন। যারা মেঘনার করালগ্রাসে বাপ-দাদার ভিটে মাটি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন তাদের চোখে এখন আলোর ঝিলিক, হারানো ভূমি ফিরে পাবার দৃঢ় আশা।
সন্দ্বীপের দীর্ঘাপাড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, দীর্ঘাপাড় ইউনিয়নটি সাগরে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় জেগে উঠেছে। এর আশে পাশে যেভাবে চর জেগে উঠছে তাতে সেদিন আর দূরে নয়, অচিরে আমরা উড়িরচরসহ কোম্পানিগঞ্জের সঙ্গে মিশে যাব।
সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাস্টার শাহজাহান বলেন, ৬০ মৌজার সন্দ্বীপ ইতোমধ্যে কয়েকটি সাগর থেকে উদ্ধার হয়েছে। সরকার পরিকল্পনা গ্রহণ করলে খুব দ্রুত এ এলাকায় বিশাল ভূমি জেগে উঠবে।
সূত্র জানায়, সন্দ্বীপের উত্তর পশ্চিমে ষাটের দশকে জেগে উঠা বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন উড়িরচরের দক্ষিণে জেগে উঠেছে আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ চর। আবার দ্বীপের পশ্চিমে চর জাহাইজ্যা (স্বর্ণদ্বীপ), চর ক্যারিং, ঠ্যাংগার চর মিলে জেগে উঠা নতুন ভূমির পরিমাণ সন্দ্বীপের প্রায় দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হতে পারে বলে আশা করছেন স্থানীয়রা।
ভূ-উপগ্রহের চিত্র বিশ্লেষণে সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকরা মতামত ব্যক্ত করে বলেছেন, সন্দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে নোয়াখালী, হাতিয়া, সন্দ্বীপজুড়ে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে জেগে উঠা নতুন নতুন চরগুলোর আশে পাশে পলি জমে বিস্তৃত হয়ে সাগর মোহনায় সাংগু গ্যাস ফিল্ডের কাছাকাছি চলে গেছে। দিন দিন এ চরের পরিধি শুধু বাড়ছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ৫০ বছর ধরে মেঘনা মোহনায় ভূমি জাগরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এ অঞ্চলে প্রায় ছয় লাখ হেক্টর নতুন ভূমি জেগে উঠেছে। কখনও প্রকৃতির আপন খেয়ালে আবার কখনও ক্রসবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এ সকল ভূমি উদ্ধার হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের মেঘনা সমীক্ষা-২০০১ এর মতে প্রাকৃতিকভাবে প্রতি বছর প্রায় ২০০০ হেক্টর ভূমি এ মোহনায় জেগে উঠছে। তবে বর্তমানে এ পরিমাণ আশাতীতভাবে বেড়ে চলছে।
১৯৫৭ সালে ১৩ কিলোমিটার ও ১৯৬৫ সালে ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ক্রসবাঁধ নির্মাণ করে যথাক্রমে নোয়াখালীর রামগতিকে (বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলা) মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এবং চর জব্বারকে সোনাপুর রেলস্টেশনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। উভয় বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রায় এক লাখ হেক্টর ভূমি পুনরুদ্ধার হয়। সন্দ্বীপের তিন পাশে গড়ে উঠা নতুন চর ছাড়াও এর পশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপ সংলগ্ন নিঝুম দ্বীপ, চর কবিরা, চর কালাম, চর আলীম, চর সাগরিকা, উচখালী, নিউ ঢালচরসহ প্রায় ৫০০০ বর্গ কিলোমিটার নতুন ভূমি জেগে উঠেছে। ভূমি পুনরুদ্ধার ও চর উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মতে, উক্ত এলাকায় প্রতি বছর গড়ে অন্তত ১৫-২০ বর্গ কিলোমিটার নতুন চরের সন্ধান মিলছে।
জানা যায়, সাগর মোহনায় জেগে উঠার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করাসহ এটিকে ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে সরকারের ভূমি পুনরুদ্ধার প্রকল্পে মেঘনা মোহনা অনুসন্ধান, চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিস, ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংসহ আরও কয়েকটি সরকারি সংস্থা কাজ করছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরও ছয়টি বিভাগ- এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, কৃষি, ভূমি বন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড।
হাতিয়া সংলগ্ন নিঝুম দ্বীপে মানুষের বসবাসের পাশাপাশি বনবিভাগ সৃষ্ট বনাঞ্চলে রয়েছে হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন বন্য প্রজাতির অবাধ বিচরণ। সন্দ্বীপের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ইউনিয়ন উড়িরচরের পশ্চিমে সৃষ্ট নতুন চরে হেঁটে চরলক্ষ্মী যাওয়া যায়। জাহাইজ্যা বা স্বর্ণদ্বীপ থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে ভাসানচরে (ঠ্যাংগার চর) এখন চলছে রোহিঙ্গা স্থানান্তরে বিশাল কর্মযজ্ঞ।
জেগে উঠা ভূমির স্থায়িত্ব সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সাইন্স অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন মুন্না বলেন, “সন্দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমের ঠেংগার চর (ন্যামস্তি চর) বয়ে আসা স্রোতধারার লোড নিচ্ছে, যার ফলে দ্বীপের পশ্চিমে ফুলে উঠা বিশাল ভূমি টিকেও যেতে পারে। তবে ভূমি উদ্ধারের এ বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে ফিজিক্যালি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি হার্ড ও সফট ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল প্রয়োগ করে সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে কুতুবদিয়াতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
তিনি ভূমি সংরক্ষণের স্বার্থে বামনী, হাতিয়া ও সন্দ্বীপ চ্যানেলে স্বল্প পরিসরে ড্রেজিংয়ের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন। জেগে উঠা নতুন ভূমি খুলে দিচ্ছে সম্ভাবনার স্বপ্ন দুয়ার। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, জেগে উঠা ভূমি সংরক্ষণের বিষয়ে জরুরিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন ভূমি সংরক্ষণ করা সম্ভব হলে বদলে যাবে দেশের মানচিত্র। তাতে উদ্বাস্তু ও ভূমিহীনদের পুনর্বাসনসহ কৃষি-পশুপালন ক্ষেত্রে বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সন্দ্বীপে অর্থনৈতিক অঞ্চল:
বঙ্গোপসাগরবেষ্টিত সন্দ্বীপ উপজেলার একসময় সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ এলাকা ছিল সন্তোপুর, আমানুল্লাহ ও দীর্ঘাপার ইউনিয়ন। এসব এলাকার হাজার হাজার বাস্তুহারা মানুষ সন্দ্বীপ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে। তবে সেই ভাঙন থেকে প্রায় তিন দশক আগে চরের দেখা মেলে সন্দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলটিতে। আর সেই জেগে ওঠা চরকে কেন্দ্র করে বিশেষ অথনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা করছে সরকার। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনায় উদ্যোগী হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নকারী সংস্থা বেজা। ভূমি জরিপের জন্য জিওলজিক্যাল সার্ভে বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
ভবিষ্যতের জন্য সন্দ্বীপ উপকূলে জেগে ওঠা জমি শিল্পায়নে ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া হবে উল্লেখ করে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের আরেকটি গন্তব্য হচ্ছে সন্দ্বীপ। এর উপকূলে যে বিশাল চর জেগে উঠেছে সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে সন্দ্বীপকে ঘিরে। জেগে ওঠা চরটিতে যথাযথ সার্ভে করে বেজার আওতায় নিয়ে আসা হবে। জিওলজিক্যাল সার্ভে বিভাগকে নিযুক্ত করা হয়েছে। তারা ইতিমধ্যে সার্ভে সম্পন্ন করেছে। আশা করছি খুব দ্রুত সেই রিপোর্ট পেয়ে যাব।
সম্প্রতি সন্দ্বীপের সবুজ চরের সন্তোষপুর অংশে উপকূলীয় বাঁধে দাঁড়িয়ে যত দূর চোখ যায় শুধু বিস্তীর্ণ চর। জায়গায় জায়গায় খড়ের গাদা। চরজুড়ে গবাদি পশুর রাজত্ব। গরু, মহিষ চড়ে বেড়ালেও বিভিন্ন জায়গায় ঘেরাও দিয়ে বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। সন্তোষপুর, আমানুল্লাহ এবং দীর্ঘাপার ইউনিয়ন নিয়ে মূলত গড়ে উঠেছে এই সবুজ চর।
সেখানে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা কৃষক আলী হোসেনের সঙ্গে। ভাঙনে বাস্তুহারা হয়েছিলেন। কিন্তু জেগে ওঠা চরে আবার নতুন করে ঘর বেঁধেছেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে আলী হোসেন বলেন, সুবিশাল চরে ধান চাষ আর গবাদি পশু পালনই স্থানীয়দের একমাত্র পেশা। তবে সন্দ্বীপের অন্যান্য এলাকায় দুই থেকে তিনটি ফসল হলেও সবুজ চরে মূলত বোরো ধানের এক ফসল করা হয়। যেহেতু গবাদি পশু পালনও একটি লাভজনক পেশা, তাই বাকি সময়টা গবাদি পশু পালন করা হয়।
‘তবে সমুদ্র তীরবর্তী এমন আকর্ষণীয় একটি জায়গা গবাদি পশুর চারণভূমি কিংবা এক ফসলি চাষের জন্য ফেলে রাখা সম্ভাবনার বিশাল অপচয়’ বলেন বিশেষজ্ঞরা।
যোগাযোগ ব্যবস্থার দূর্বলতা:
চারদিকে সমুদ্র বেষ্টিত হওয়ায় সড়ক যোগাযোগের অভাবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পিছিয়ে আছে সন্দ্বীপ। বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ন্যূনতম নাগরিক অধিকার হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ১২ মাস সন্দ্বীপ আসা যাওয়ার নিরাপদ ব্যবস্থা করতে হবে। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নিয়োজিত বেসরকারি ঠিকাদার ছাড়াও বিআইডব্লিউটিসিকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। বর্তমানের একচেটিয়া ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রতিযোগিতামূলক বেসরকারি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সন্দ্বীপকে নদীবন্দর ঘোষণা করে নৌযান চলাচলের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। বর্তমানে গুপ্তছড়া ঘাটটি শুধু দক্ষিণ সন্দ্বীপের জন্য সুবিধাজনক। তাই উত্তর সন্দ্বীপের অধিবাসীদের যাতায়াতের জন্য গাছুয়া ঘাট ও তৎসংলগ্ন রাস্তাটির সংস্কার করতে হবে। নদীভাঙা পরিবারগুলোকে জমি দিতে হবে, তাদের জন্য গৃহ নির্মাণ করতে হবে। ভাসানচরের সঙ্গে হাতিয়ার অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং আইনসংগতভাবে এর নিষ্পত্তি করতে হবে। স্থলভাগের সঙ্গে সন্দ্বীপের সংযোগের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্রসড্যাম নির্মাণ করতে হবে।
শিল্প ও নগরায়ন:
বিদ্যুৎ সুবিধা না থাকায় শিল্প-কারখানা এবং নগরায়ণের তেমন কোনো সুবিধা নেই এই দ্বীপটিতে। যদিও এই দ্বীপের বড় একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, উপজেলাভিত্তিক রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে সন্দ্বীপের অবস্থান দ্বিতীয়। তবে দীর্ঘ দিনের বিদ্যুতের সেই বাধাও দূর হতে চলেছে। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১৪৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সন্দ্বীপের মানুষ প্রথমবারের মতো জাতীয় গ্রিডের আওতায় বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে।
সন্দ্বীপের অর্থনৈতিক অঞ্চলের ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন বলেন, সন্দ্বীপের ব্যাপারে আমাদের কাছে এখনো লিখিত নির্দেশনা আসেনি। তবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যেহেতু সন্দ্বীপ একটি সম্ভাবনাময় জায়গা, তাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য কোন জায়গাটি সুবিধাজনক সেটা খুঁজে বের করব।
সন্দ্বীপ পৌরসভার মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু বলেন, ছোট ছোট শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য সন্দ্বীপে বিসিক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রতিশ্রুতি ছিল। এ জন্য বেশ কয়েকটি জায়গাও দেখা হয়েছিল। কিন্তু পরে আর বিষয়টি সেভাবে এগোয়নি। তবে এখন শুনেছি, প্রধানমন্ত্রী নিজেই সন্দ্বীপের একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে আগ্রহী। এটা যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে সন্দ্বীপবাসীর জন্য হবে সবচেয়ে বড় পাওয়া। সন্দ্বীপে জেগে ওঠা চরে বিশাল জমি পতিত অবস্থায় পড়ে আছে। এটা যদি শিল্পায়নের কাজে লাগানো হয় তাহলে পিছিয়ে থাকা সমুদ্রবেষ্টিত এই জনপদটির আর্থসামাজিক অবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে।