দিনমজুর বাবা শেখ মো. আফজাল হোসেনের ছেলে শেখ মুহাম্মদ আতিফ আসাদের (২০) বাড়ি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার ৩নং ডোয়াইল ইউনিয়ন পরিষদের হাসড়া মাজালিয়া গ্রামে।
সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ আসাদ লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজমিস্ত্রি, রডমিস্ত্রির কাজ, খাট বার্নিশ ও ধান কাটার কাজ করেন। চলতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন। নিজের আর্থিক দুরাবস্থাকে পেছনে ফেলে বই পড়ার স্বপ্নকে ধারণ করে ইতিমধ্যে গ্রামে নিজের চৌচালা ঘরের বারান্দায় গড়ে তুলেছেন ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের বারান্দায় পাটকাঠি দিয়ে তৈরি ছোট ঘরটিতেই স্থান পেয়েছে পাঠাগারের অসংখ্য বই। স্কুলে পড়াকালীন টুকটাক লেখালেখির আগ্রহ ছিল তার। সেই লেখালেখি থেকে তৈরি হয় বই পড়ার অভ্যাস। বই পড়ার অভ্যাস স্বপ্ন দেখেন পাঠাগার গড়ে তোলার।
বড় ভাই রবিউল ইসলাম মিলনের সঙ্গে নিয়ে পাঠাগার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। জমি সংক্রান্ত বিবাদে ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে দুর্বৃত্তরা হত্যা করেন রবিউল ইসলাম মিলনকে। ভাইয়ের স্মৃতি ধরে রাখতেই ওই বছরের জুলাই মাসে তার সংগ্রহে থাকা ২০টি বই দিয়েই শুরু করেন ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’। ধীরে ধীরে পাঠাগারের বই এর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই আসাদ তার পাঠাগারের জন্য বইয়ের বিষয়ে সাহায্য চান। এতে সাড়াও পড়ে অনেক। আসাদের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে পাঠাগারের জন্য বই দিয়েছেন অনেকেই।
এরমধ্যে ভিয়েতনামের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজের দেয়া পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পাঠাগারের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বিভিন্ন বই কেনা হয়েছে। এছাড়াও অনেক বিত্তশালী পাঠাগারের জন্য বই দিয়েছেন।
গ্রামের লোকেদের মাঝে বই পড়ার আগ্রহ গড়ে তুলতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন আতিফ আসাদ। বিশেষ করে বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিনিয়ত বই পড়ার বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করেন। শুধু তাই নয়, সাইকেলে করে পাঠকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দেন। আবার সপ্তাহান্তে পড়া শেষে বইগুলো ফেরত নিয়ে আসেন। ১০-১৫ কিলোমিটার দূর থেকেও ফোন করলে সাইকেল দিয়ে বাড়িতে গিয়ে বই দিয়ে আসেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ মুহাম্মদ আতিফ আসাদ ইউএনবিকে বলেন, গ্রামের মানুষ অর্থের অভাবে লেখাপড়াই করতে পারে না, সেখানে এসব বই পড়া অনেক দূরের বিষয়। এই পাঠাগারের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় বই পড়ার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়াই আমার ইচ্ছা।
সামর্থ্যবানদের সকলেই গ্রামীণ এলাকায় এই ধরনের পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়ার আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে পাঠ্যবইয়ের বাইরের বিভিন্ন বই পাওয়া যায়না বললেই চলে। এসব গ্রামীণ জনপদের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠাগারের সংগৃহীত বই বাড়তি জ্ঞানের আলো ছড়াবে।
ছেলের এমন মহৎ উদ্যোগকে গর্বের চোখে দেখছেন তার বাবা শেখ মো. আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি পড়ালেখা ছাড়া মানুষ। আমার ছেলের এমন চেষ্টার কারণে দশজন লোক আমাকে বাড়তি সম্মান দেখায়। আগে আমার বাড়িতে মানুষ আসতইনা। এখন শুধু বই পড়ার জন্য অনেক মানুষ এই বাড়িতে আসে। এই যে জ্ঞানের আলো ছড়াতে আমার ছেলে কাজ করে যাচ্ছে বাবা হিসেবে সেটি আমার জন্য বড় সম্মানের বিষয়।’
সরিষাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শিহাব উদ্দিন আহমদ ইউএনবিকে বলেন, আসাদের এমন উদ্যোগ আমাদের উপজেলার জন্য অবশ্যই গর্বের। তার এই কাজ সবার মাঝে প্রশংসনীয়। এরকম ব্যতিক্রম ইচ্ছায় গড়ে তোলা পাঠাগার প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-নির্ভর বই পড়তে সহায়তা করে। প্রশাসনিক জায়গা থেকে অনেক নিয়ম-নীতি মানতে হয় আমাদের।
তবে আতিফ আসাদের পাঠাগারের জন্য যদি কোনো সহায়তার প্রয়োজনে আবেদন করেন তবে উপজেলা প্রশাসন তার পাশে থাকবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।