দখলের পর নদীর সম্পত্তিতে নির্মিত হয়েছে দোকানপাট ও বহুতল ভবন। প্রাকৃতিক এই জলাধারে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। নদী পাড়ে গেলে মনে হয়, সবাই যেন নদীটি দখল ও ভরাটের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন!
এছাড়া নদীর বিভিন্ন অংশে নদীর পাশের ঘরবাড়ির পয় নিষ্কাশনের পানি এবং আবর্জনা ফেলায় নদীটি এখন প্রায় মৃত।
স্থানীয় বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, ‘সঠিক পরিকল্পনা নিলে পুরাতন গোমতী হয়ে উঠতে পারে কুমিল্লা নগরীর ফুসফুস।’
২০১৭ সালে সিটি নির্বাচনের সময় বর্তমান মেয়র পুরাতন গোমতী নদীকে রাজধানীর হাতিরঝিলের রূপ দেওয়ার ইশতেহার দিয়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু এখনো কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কুমিল্লার মানুষ মেয়রের এই ঘোষণার দ্রুত বাস্তবায়ন চায়।’
গত কয়েক বছরে নদীর দুই পাড় দখল করে কাঁচা-পাকা অবৈধ স্থাপনা তৈরি করেছেন, এমন ৫২২ জন ব্যক্তির তালিকা তৈরি করেছিল জেলা প্রশাসন। ওই তালিকা তৈরি প্রথম শুরু করা হয়েছিল ২০০৩ সালে। ওই সময় থেকে দখলদারদের নদীর জায়গা ছেড়ে দিতে ১০ বারের বেশি নোটিশ দেয় প্রশাসন। এতেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। শুধু তালিকা তৈরি ও নোটিশ দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে নদীর সম্পাত্তি উদ্ধার অভিযান।
গোমতী নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলের ডুমুর নামক স্থানে উৎপন্ন হয়েছে। নদীটি ত্রিপুরা রাজ্যের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুমিল্লার বিবিরবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর নদীটি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গিয়ে মেঘনা নদীতে পড়েছে।
বর্ষায় নদী কানায় কানায় পূর্ণ থাকার কারণে গত শতাব্দীর ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত নদীটিকে কুমিল্লার দুঃখও বলা হতো। তখন বর্ষার সময় নদীর পানিতে কুমিল্লায় বন্যাও হতো। সে সময় কুমিল্লা নগরীকে বন্যার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ষাটের দশকে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ বদলে দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় থেকে নদীর কুমিল্লা সদরের কাপ্তানবাজার থেকে চানপুর-শুভপুর পর্যন্ত অংশটুকুকে মানুষ পুরাতন গোমতী নামেই ডাকে। পুরাতন গোমতীর দৈর্ঘ্য প্রায় ছয় কিলোমিটার।
সরেজমিনে পুরাতন গোমতীর চানপুর, ডুমুরিয়া চানপুর, শুভপুর, টিক্কারচর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নদীর বেশিরভাই সম্পত্তিই অবৈধ দখলে। নদীর ওপর পাঁচটি স্থানে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার নিচে পানি চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ড্রেন। নদীর দুই পাড়ে নির্মিত হয়ে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। কোথাও কোথাও নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে তৈরি করা রাস্তার দুই দিকেই তৈরি করা হয়েছে দোকান। যা একেবারেই নদীর মধ্যখানে।
স্থানীয়রা জানান, নদীর পানি কালো ও দুর্গন্ধময়, এই পানিতে এখন কেউ নামে না। এই নদীটির সম্পর্কে বিস্তারিত না জানলে যে কারোরই মনে হবে এখানে খণ্ড খণ্ড কয়েকটি ডোবা! সব মিলিয়ে নদীটি এখন পুরোপুরি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বলা যায় নদীটি এখন পুরোপুরিই মৃত!
সূত্র জানায়, পুরাতন গোমতী নদী থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করার জন্য প্রশাসন পদক্ষেপ নিলেও রাজনৈতিক এবং বিভিন্ন কারণে তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। গত বছর হালনাগাদ তালিকা অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে নদীর ২৫৮ দশমিক ৭৪ একর জায়গা অবৈধ দখলদারমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে এ খবর পেয়ে দখলদাররা অভিযান ঠেকাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তদবির শুরু করেন।
কাপ্তানবাজার, ভাটপাড়া, শুভপুর, চানপুর, সুজানগর, গাংচর, টিক্কারচর, মোগলটুলী শাহসুজা মসজিদ রোড, পুরাতন চৌধুরীপাড়া, বজ্রপুরসহ বিভিন্ন এলাকার মধ্যে পুরাতন গোমতীর দুই পাড়ের কয়েক’শ একর সম্পত্তি অবৈধ দখলদারদের কবলে রয়েছে।
দখলদারদের তালিকায় বেশিরভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী রয়েছেন। আছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরাও। তারা নদীটি দখল করে নির্মাণ করেছেন বাড়িঘর ও দোকানপাট।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নদীটি রক্ষায় আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি। জেলা প্রশাসক ও সিটি মেয়রকে স্মারকলিপি দিয়েছি।’
‘তবে দেশে আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ না থাকায় নদী দখলের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। নদীটি রক্ষা করতে হলে প্রশাসনকে অভিযানে যেতে হবে,’ বলেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), কুমিল্লার নির্বাহী প্রকোশলী মো.আবদুল লতিফ বলেন, ‘আমরা দখলকারীদের তালিক তৈরি করেছি। সেই তালিকা জেলা প্রশাসনকেও দেওয়া হয়েছে। আমাদের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। তারপরও আশা করছি জেলা প্রশাসনসহ দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযান চালিয়ে নদীর সম্পত্তি উদ্ধার করতে পারবো।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, ‘নদীর দুই পাড়ের অবৈধ দলখ ও স্থাপনা উচ্ছেদে আমাদের অভিযান নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে। নদীর সম্পত্তি উদ্ধার ও দখলমুক্ত করতে আমাদের এই অভিযান নিয়মিত চলমান থাকবে।’