পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় সুস্বাদু খাবার হিসেবে অতি পরিচিত ‘বাঁশ কড়ুল’। মারমা সম্প্রদায়ের কাছে এ খাবার ‘মহ্ই’, ত্রিপুরাদের কাছে ‘মেওয়া’ আর চাকমা ভাষায় একে বলা হয় ‘বাচ্ছুরি’। মজাদার তরকারি হিসেবেও ‘বাঁশ কড়ুলে’র কদর রয়েছে।
পাহাড়ি জীবনের শত শত বছরের বিশেষ ঐতিহ্যবাহী অনুষঙ্গ হওয়ায় প্রতিদিন দূর-দূরান্তের গভীর জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা হয় এই বাঁশ কড়ুল। এ অঞ্চলের অনেক বাঙালিও এখন এটি খাওয়ায় বেশ অভ্যস্ত। মূলত বাঁশের গোঁড়ার কচি নরম অংশকে বলা হয় বাঁশ কড়ুল। পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় সব জায়গাতেই মেলে এ সবজি।
বছরের মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এ সবজির ভরা মৌসুম থাকে। পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে মুলি বাঁশ, ডলু বাঁশ, মিতিঙ্গ্যা বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ, বাজ্জে বাঁশ, কালিছুরি বাঁশসহ বেশ কয়েক প্রজাতির বাঁশ কড়ুল পাওয়া যায়। বর্ষার শুরুতে বৃষ্টির পানিতে মাটি নরম হলে এটি বাঁশের ফাঁকে বড় হতে শুরু করে। মাটি থেকে ৪-৫ ইঞ্চি গজিয়ে উঠলে এটি খাওয়ার উপযোগী হয়। বাঁশের জাত অনুযায়ী বাঁশ কড়ুলের স্বাদও ভিন্ন হয়। তবে মুলি বাঁশ কড়ুল বেশি সুস্বাদু হওয়ায় সবার কাছে এটি খুবই জনপ্রিয়।
বর্ষার শুরুতেই প্রায় প্রতিদিন সকালে জেলা শহরের বিভিন্ন বাজারে, আর বিকালে পাহাড়িরা কাঁধে করে নিয়ে আসে এই বাঁশ কড়ুল। বাজারে ছোট ছোট থুরুং নিয়ে বাঁশ কড়ুলের পসরা নিয়ে বসেন স্থানীয় নারী- পুরুষেরা।
প্রতি কেজি বাঁশ কড়ুল পাওয়া যায় ৮০-১০০ টাকার মধ্যে। তবে চাহিদা অনুযায়ী এর দাম কম বেশি হয়ে থাকে। সবার আগে বাজারে পাওয়া যায় মিটিংগ্যা বাঁশ কড়ুল। বাজারে প্রথম আসায় একচেটিয়া বাজার দখল করে নেয় এটি।
বর্তমানে পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে স্থানীয় হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতেও খাবারের তালিকায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই সবজি। পার্বত্যাঞ্চলে ঘুরতে আসা পর্যটকদেরও অন্যতম আকর্ষণ এই বাঁশ কড়ুল। স্বাদে অতুলনীয় এই সবজি শুধু পাহাড়িদের জন্য নয়, দেশের সব মানুষের এখন অতিপ্রিয় খাবারে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলা থেকে চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় এই বাঁশ কড়ুল বিক্রির উদ্দেশ্যে কিনে নিয়ে যান খুচরা ও পাইকারী বিক্রেতারা।
তবে এক সময় পাহাড়ে বাঁশ কড়ুলের মৌসুমে এটির ভরপুর থাকলেও ৫-৬ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিকভাবে বাঁশে মোড়ক ধরায় কমে এসেছে বাঁশবন। ফলে বাঁশ কড়ুলও চাহিদা মতো বাজারে আসছে না। উৎপাদনের স্বার্থে জুন-আগষ্ট পর্যন্ত বাঁশ আহরণ বন্ধ রাখতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কাপ্তাই রেঞ্জ কর্মকর্তা মাহাবুব উল আলম। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাঁশ বাগান এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে বাঁশ কড়ুল আহরণের নামে তিন পার্বত্য জেলায় নির্বিচারে কচি বাঁশ কেটে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে প্রাকৃতিকভাবে বাঁশের বংশবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তাই বাঁশের উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বর্ষা মৌসুমে দুই থেকে তিন মাস এই বাঁশ কড়ুল উত্তোলন বন্ধ রাখার তাগিদ সংশ্লিষ্টদের।