২২ বছর বয়সী আরিদ (ছদ্মনাম) এবং ২৫ বছর বয়সী রাহিল (ছদ্মনাম)। দুজনেই স্টেরয়েডের অস্বাভাবিক ব্যবহার করায় লিভার এনজাইম এবং হরমোনাল ইমব্যালান্স এর মতো সমস্যা নিয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসে। একজনের লিভার এনজাইম অস্বাভাবিক এবং আরেকজনের টেস্টেস্টরন হরমোন প্রডিউস বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত এই বয়সে এটা হওয়ার কথা না। জিমে গিয়ে স্টেরয়েড সঠিক মাথায় না নেওয়ায় এবং সঠিক বয়সে না নেওয়ায় তাদের আচরণগত অস্বাভাবিকতা দেখে পরিবার বুঝতে পারে। কারণ জিম করেও তারা শুকিয়ে যাচ্ছিল। পরে তাদেরকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। এখনো তারা সুস্থ হয়ে উঠতে(রিকভার) পারেননি বলে জানান গ্রীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক ডা. রায়হান শহীদুল্লাহ। কারণ এর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল।
ডা. রায়হান শহীদুল্লাহ বলেন, স্টেরয়েড সাধারণত দুই ধরণের হয়ে থাকে। একটা হলো চিকিৎসকরা বিভিন্ন রোগ অনুযায়ী প্রেসক্রাইব করেন। আর জিমে যেটা বডি বিল্ডিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় যেগুলো আর্টিফিসিয়াল। বাংলাদেশে যেগুলো ফার্মাসিটিউক্যালস আছে তারা কেউ কিন্তু এগুলো উৎপাদন করে না। এগুলোর বেশিরভাগই চায়না থেকে এমনকি ইন্ডিয়া থেকেও নিয়ে আসা হয়। যার বেশিরভাগ আবার আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রাগ। এই স্টেরয়েড প্রেসক্রাইব করার কোনো অথেনটিসিটি নেই। কোনো চিকিৎসক এগুলো বডি বিল্ডিংয়ের জন্য প্রেসক্রাইব করেন না। কারণ এর কোনো অনুমোদনই নেই।
তিনি বলেন, 'কোনো ফার্মেসিতে এটা পাবেন না। দুই একটা পাওয়া গেলেও সেটা নির্দিষ্ট কোনো রোগের জন্য যেমন ব্রেন ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার এসব ক্ষেত্রে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর এগুলো খুব ব্যয়বহুল এবং সহজলভ্য না। আর চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনো ফার্মেসি কাউকে দেবে না।’
তাহলে জিমে দেওয়া হচ্ছে এটা কি না জেনেই? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আগে মানুষ জানতো না তেমন। এখন তিন চার বছর ধরে মানুষ কিছুটা হলেও জানতে পারছে। দশ বছর আগেও মানুষ জানতো না বা বুঝতো না। অনেকে এগুলোকেই সাপ্লিমেন্ট মনে করতো। তবে জিমে এটা রাখাই রীতিমত অনুচিত।
ধানমন্ডির একটি জিমে নিয়মিত শরীরচর্চা করা সোহাগ আমিন ইউএনবিকে তিনি বলেন 'আমাদের এখানে সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়। স্টেরয়েড আসলে ছেলেরা ইচ্ছে করেই নেয় দ্রুত মাসল বৃদ্ধির জন্য। কাউকে জোর করা হয় না। তবে আমি কখনো নেইনি। কারণ আমি জানি এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।’
বাড্ডার আরেকটি জিমে শরীরচর্চা করা রাফি মাহতাব বলেন 'আমি কয়েকটি জিমে এখন পর্যন্ত গিয়ে দেখেছি যে সেখানে স্টেরয়েড থাকে। সব জিমে দেখিনি। বরং স্বনামধন্যগুলোতে দেওয়া হয় না। তবে কোনো জিমেই জোর করা হয় না। চাইলেই তবে দেওয়া হয়।'
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
স্টেরয়েডের প্রধান কাজটাই হলো মাসল বাড়ানো। যেটা জিম করে এক বছরে বাড়ানো যায় সেটা স্টেরয়েড ব্যবহার করে দুই বা তিন মাসে করে ফেলা যায়। এতে শরীরে প্রাকৃতিকভাবে যে হরমোনটা তৈরি হয় সেটা স্থায়ীভাবে 'সাট ডাউন' বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে শরীরে। এটা সবচেয়ে বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
ছেলেদের ক্ষেত্রে অনেক সময় টেস্টোস্টেরন হরমোন প্রডাকশনই বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। যদি মেইল হরমোন অর্থাৎ ছেলেদের হরমোনই না থাকে সে তো পুরুষের মতো আচরণ করবে না। এটাও একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
আরও পড়ুন: এমপক্স ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
এছাড়া লিভারে সমস্যা এমনকি হার্ট ফেইলিউর হতে পারে।
ডা. রায়হান বলেন, সঠিক নিয়মে জিম না করলে জয়েন্টে ইফেক্ট হতে পারে। লিগামেন্ট ছিঁড়ে যেতে পারে। এমনকি অপারেশন পর্যন্ত করা লাগতে পারে। তাই স্টেরয়েড নিলেও চার সপ্তাহ পর বন্ধ করতে হবে। হরমোনাল ব্যালান্স আবার আগের অবস্থায় আসার জন্য ‘পোস্ট সাইকেল থেরাপি’ দিতে হয়।
অলিতে গলিতে জিম, প্রশিক্ষক নেই এবং ইনজুরি
রাজধানীর বাড্ডা ও আফতাবনগরের কিছু জিম ঘুরে দেখা যায় সেগুলোতে তেমন কোনো ভালো প্রশিক্ষক নেই।
ট্রেনিংয়ের বিষয়ে মিস্টার বাংলাদেশ এবং ফিটনেস কোচ সাকিব নাজমুস বলেন ' আমি মালয়েশিয়া থেকে ছয় মাসের একটি ট্রেনিং নিয়েছি। সব জিমে ট্রেইনার নেই, আবার জিম করতে করতে অভিজ্ঞতা হয়ে গেলে ট্রেইনার হয়ে যায়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। কারণ জিমে ট্রেইনিং দেওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অবশ্যই থাকে যদি এটা দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার করা হয়। এটি ব্যবহার করলেও শর্ট টাইমের জন্য অর্থাৎ সর্বোচ্চ পাঁচ মাস ব্যবহার করতে পারে। কখনোই দীর্ঘমেয়াদি নয়। আর মঞ্চে অংশগ্রহণ করে প্রতিযোগিতায় না গেলে এটি সাজেস্ট করা তো দূরের কথা নিরুৎসাহিত করা হয়।
আপনি কখনো সাজেস্ট করেছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন' ‘আমি কখনোই সাজেস্ট করিনি। যদি না সে প্রতিযোগিতায় যায়। এটি স্বল্প সময়ের (শর্ট টাইম) জন্য নিলেও আবার রিমুভ করা যায়। এর জন্য কিছু মেডিসিন এবং ইনজেকশন আছে। সেটারও একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়। ওজন কমানো বা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলেও স্টেরয়েড আসলে কোনোভাবেই অনুমোদিত না।'
যা বলছে ওষুধ প্রশাসন
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক নুরুল আলম ইউএনবিকে বলেন, 'স্টেরয়েড সাধারণত চিকিৎসকরা ব্যবহার করেন। মানুষের জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকরা যখন কোনো জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হন কেবল তখনই রোগীকে স্টেরয়েড দেওয়ার প্রয়োজন হলে দিয়ে থাকেন। জিমে এটি ব্যবহার করা হয় সেটা তো আমাদের অজানা।’
বিষয়টি জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমি জিমগুলোতে খোঁজ নেব। মাসল বিল্ড একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সেটি তো হবেই একটা নির্দিষ্ট টাইম লাগবে। তাড়াহুড়া করে বডি বিল্ড করার নামে ব্যবসা করছে এমন প্রমাণ পেলে আমরা অবশ্যই প্রশাসনকে জানিয়ে ব্যবস্থা নেব।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, চাপ সৃষ্টি হচ্ছে ভঙ্গুর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর