বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম ১০ দিনেই বাইডেন বেশ কিছু নির্বাহী আদেশ জারির কাজ শুরু করছেন। এই আদেশগুলো প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে জারি করা নির্বাহী আদেশ, যার জন্য কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না।
বাইডেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি নির্বাহী আদেশ হলো- বিতর্কিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা। পূর্বসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্প নিরাপত্তা হুমকির কারণ দেখিয়ে প্রধানত যেসব মুসলিম দেশ থেকে আমেরিকায় ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, সেগুলো প্রত্যাহার করে নেয়া। আর দ্বিতীয়টি হল প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আবারও যোগদান করা।
আরও পড়ুন: কয়েক লাখ অভিবাসীকে নাগরিকত্বের মর্যাদা দিতে যাচ্ছেন বাইডেন
এছাড়াও নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে যে বিষয়গুলোর দিকে তিনি অবিলম্বে নজর দিতে চান বলে জানা যাচ্ছে সেগুলো হল:
করোনা মোকাবিলায় আমেরিকানদের মাস্ক পরানো
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বিশ্বের সবেচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তে দেশ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে করোনা মৃতের সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়েছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি।ফলে এই মহামারি মোকাবিলায় নতুন প্রশাসনের অগ্রাধিকারের তালিকায় এটি সবার উপরে থাকবে সহজেই অনুমেয়।
বাইডেনের ভাষ্য, ‘আমাদের প্রশাসনের জন্য এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই’ এবং তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর কোভিড মোকাবিলায় তার কৌশল বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
১০০ দিনে ১০০ মিলিয়ন ডোজ টিকা
দ্রুত ছাড়ানো করোনাভাইরাসকে রুখে দিতে বাইডেন টিকাদান প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার করতে চান। তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হল তার ক্ষমতায় প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে দশ কোটি মানুষকে করোনার টিকার অন্তত প্রথম ডোজ দিয়ে দেয়া।
টিকা কর্মসূচি দ্রুততার সাথে করার একটা পরিকল্পনা হল যত ভ্যাক্সিন তৈরি আছে তার একটা অংশ দ্বিতীয় ডোজের জন্য মজুত রাখার বদলে, পুরোটাই একসাথে ছেড়ে দেয়া।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আবারও যোগদান
আমেরিকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নাকচ করে দেবার প্রতিশ্রুতিও বাইডেনের কার্যতালিকায় রয়েছে। এ ব্যাপারে নির্বাহী আদেশ এরই মধ্যে জারি করেছেন তিনি
সংস্থাটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, চীনে এই ভাইরাস প্রথম ধরা পড়ার পর সংস্থাটি কোভিডের বিস্তার ঠেকাতে এবং সংস্থায় ‘জরুরিভাবে প্রয়োজনীয় সংস্কার’ আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার করোনাভাইরাস অর্থনীতি
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিপর্যস্ত আমেরিকান অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের জন্য গত সপ্তাহে বাইডেন ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন এবং বলেছেন যে ‘মানুষের দুঃসহ মাত্রার দুঃখকষ্ট যে একটা সংকটময় পরিস্থিতে পৌঁছেছে, তা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এবং এখন নষ্ট করার মত সময় হাতে নেই।’
এই প্যাকেজ কংগ্রেস অনুমোদন করলে তা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখবে বলে বাইডেন মনে করছেন। স্কুল নিরাপদে খোলার জন্যও এই প্যাকেজে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
গত ডিসেম্বরে কংগ্রেস ৯০০বিলিয়ন ডলারের যে আর্থিক প্যাকেজ অনুমোদন করেছিল এটা তার ওপর বাড়তি প্রণোদনা প্যাকেজ। রিপাবলিকান আইন প্রণেতারা এই বিলের কিছু অংশের বিরোধিতা করতে পারেন এমন সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ মহামারির প্রভাব সামাল দিতে আমেরিকা যে ঋণ নিয়েছে তার বোঝা এর ফলে আরও বাড়বে। পরিকল্পিত এই বিল পাশ হতে হলে বাইডেনের জন্য রিপাবলিকানদের সমর্থনের প্রয়োজন হবে।
কংগ্রেসের উভয় কক্ষেরই নিয়ন্ত্রণ এখন ডেমোক্র্যাটদের হাতে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা খুবই অল্প ব্যবধানের।
ট্রাম্পের কর সুবিধা বাতিল
বাইডেন তার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনায় শুধু কোভিড মোকাবিলার জন্য অর্থ সহায়তার প্রস্তাবই রাখেননি। ট্রাম্প যে কর ছাড় দিয়েছেন তা বাতিল করার প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন।
ট্রাম্প তার ক্ষমতার প্রথম দিকে ২০১৭ সালে যে কর ছাড় অনুমোদন করেন, বাইডেনের টিম বলছে সেটা শুধু ধনী আমেরিকানদের পকেট ভারী করেছে। ছোটখাট ব্যবসায়ীরা এই ছাড়ের সুবিধা মোটেও পাননি, এই সুবিধা ভোগ করেছেন বড় বড় ব্যবসায়ীরা।
প্যারিস চুক্তিতে ফিরে যাওয়া
বাইডেন বলেছেন ক্ষমতা গ্রহণ করার পর প্রথম দিনই তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আমেরিকাকে আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন। এই চুক্তিতে বিশ্ব নেতারা পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে রাখার অঙ্গীকার করেছিলেন, যেটা ছিল শিল্পায়নের আগের বিশ্বের তাপমাত্রা। তারা অঙ্গীকার করেছিলেন সম্ভব হলে তাপমাত্রা তারা ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নামিয়ে আনার চেষ্টা করবেন।
ট্রাম্প ২০১৫ সালে সম্পাদিত ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন। আমেরিকা ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা বিশ্বের প্রথম দেশ।
বাইডেন বলেছেন তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য আমেরিকা তার উদ্যোগ আরও বাড়াবে এবং প্রেসিডেন্ট পদে তার প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে তিনি বিশ্ব জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করবেন।
তিনি বলেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে আমেরিকার কার্বন নিঃসরণের মাত্রা যাতে শূণ্যে নামিয়ে আনা যায় তার জন্য এবছরই তিনি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেবেন।
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বাতিল
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণ করার মাত্র সাতদিনের মাথায় ট্রাম্প কিছু দেশ থেকে আমেরিকায় ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ট্রাম্পের যেসব নীতি দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমেই বাতিল করেছেন বাইডেন।
সাতটি মূলত মুসলিম প্রধান দেশ থেকে আমেরিকায় ভ্রমণের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, পরে আদালতে এই বিধান চ্যালেঞ্জ করে মামলা চলার পর তালিকায় কিছু রদবদল করা হয়।
অভিবাসীদের ৮ বছরের মাঝে নাগরিকত্ব দিতে বিল আনছেন বাইডেন
এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিল ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, ভেনেজুয়েলা এবং উত্তর কোরিয়া।
নাগরিকত্ব প্রদান
অভিবাসন নীতির ক্ষেত্রে বাইডেনের আরেকটি বড় প্রতিশ্রুতি হল তিনি দায়িত্ব নেবার পর প্রথম দিকেই কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপন করবেন, যার মাধ্যমে নথিবিহীন এক কোটি দশ লাখের ওপর অভিবাসীকে নাগরিকত্ব দেবার পথ প্রশস্ত হবে।
নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিকে বাইডেন ঘোষণা করেছেন, আমেরিকার দক্ষিণ সীমান্তে যে ৫৪৫ জন অভিবাসী শিশু তাদের বাবা-মায়েদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে তাদের একত্র করার জন্য তিনি একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করবেন।
সীমান্ত প্রাচীর নির্মাণ রদ
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট মেয়াদের আরেকটি বহুল আলোচিত প্রকল্প - আমেরিকা আর মেক্সিকোর মাঝখানে দেয়াল তোলা- সেই নির্মাণ কাজও বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাইডেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি বলেছেন এই প্রকল্প ‘অর্থের অপচয়’ এবং ‘যেখানে প্রকৃত হুমকি মোকাবিলায় অর্থের প্রয়োজন এই প্রকল্পের কারণে সেসব ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে না’।
বর্ণবাদ ও ফৌজদারি বিচারে সংস্কার
কোভিড, অর্থনীতি এবং জলবায়ুর পর চতুর্থ স্থানে রয়েছে বর্ণবাদের সমস্যা। বাইডেন বলেছেন তিনি দ্রুত এই সমস্যা মোকাবিলায় কাজ শুরু করবেন।
আবাসন, স্বাস্থ্যসেবাসহ যেসব ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য প্রকট সেসব ক্ষেত্রকে তিনি অগ্রাধিকার দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
প্রথম ১০০ কার্যদিবসের মধ্যে বাইডেন পুলিশ বিভাগের সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করতে চান। এ লক্ষ্যে তিনি পুলিশের কার্যকলাপের ওপর নজরদারির জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি সংস্থা গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে এই পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের প্রতি আশ্বাস
নতুন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর সাথে তিনি দ্রুত যোগাযোগ করবেন, বিশেষ করে যাদের সাথে গত কয়েক বছরে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে এবং ‘আমেরিকা তাদের পেছনে রয়েছে’ এই প্রতিশ্রুতি তাদের দেবেন।
বাইডেন বলেন, আমেরিকা ‘আবার বিশ্বে নেতৃত্ব দেবার জন্য যে তৈরি সেটা তাকে প্রমাণ করতে হবে, শুধু ক্ষমতার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে নয়, বরং দৃষ্টান্ত দিয়ে ক্ষমতাকে প্রমাণ করতে হবে।’
তিনি জানান, ওভাল অফিসে তার প্রথম কার্যদিবসে নেটো জোটের সাথে যোগাযোগ করবেন এবং এই বার্তা দেবেন যে, ‘আমরা আবার ফিরে এসেছি এবং আমাদের ওপর আবার আপনারা ভরসা রাখতে পারেন’।