প্রথাগত সঞ্চয় হিসাবের তুলনায় অধিক লাভ পাওয়ার সেরা উপায় হচ্ছে বিনিয়োগ। এর মাধ্যমে সম্পদের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বার্ধক্যকালীন আর্থিক নিরাপত্তার মতো দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সুবিধা পাওয়া সম্ভব হয়। শুধু তাই নয়; উপযুক্ত বিনিয়োগ মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায়ও যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে। এমনি একটি আর্থিক উপকরণ হচ্ছে বন্ড, যেখানে বিনিয়োগের বিনিময়ে স্থির আয় পাওয়া যায়। মেয়াদপূর্তিতে বেশ ভালো পরিমাণের রিটার্ন আসায় বিগত বছরগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিনিয়োগের এই মাধ্যমটি। তবে বাজারজুড়ে যথেষ্ট ভিন্নতা থাকায়, সঠিক বন্ডটি কেনার আগে তার যথাযথ যাচাই-বাছাই প্রয়োজন। চলুন, চূড়ান্তভাবে বন্ডে বিনিয়োগের পূর্বে কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করা জরুরি, তা জেনে নেওয়া যাক।
বন্ড কী
ঋণের বিনিময়ে একটি নিরাপত্তা চুক্তিপত্রের নাম বন্ড, যে চুক্তি ঋণগ্রহীতা হিসেবে বন্ড ইস্যুকরা প্রতিষ্ঠান এবং ঋণদাতার মধ্যে হয়ে থাকে। এখানে ঋণদাতা বা বিনিয়োগকারীকে বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান প্রাপ্ত ঋণের উপর নির্দিষ্ট হারে বিভিন্ন কিস্তিতে সুদ প্রদান করে থাকে। এভাবে পূর্বনির্ধারিত মেয়াদ পার হওয়ার পর ঋণের টাকা সুদসহ পরিশোধ করা হয়। বন্ডের অর্থের উপর নির্দিষ্ট মেয়াদে ধার্যকৃত সুদের হারকে কুপন রেটও বলা হয়। বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান ও কুপন রেটসহ মূল অর্থ প্রদানের নানা মাধ্যমের উপর ভিত্তি করে বন্ডগুলো বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: সঞ্চয়পত্রে যেভাবে বিনিয়োগ করবেন
বাংলাদেশে বন্ডের প্রকারভেদ
বন্ডে বিনিয়োগের সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ধরনের উপর ভিত্তি করে বন্ড ৩ প্রকার।
সরকারি বন্ড
এই বন্ডগুলোর আরেক নাম ট্রেজারি বন্ড, যেগুলোর মেয়াদ ন্যূনতম ২ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২০ বছরের হয়ে থাকে। এখানে সুদের হার অন্যান্য বন্ডের তুলনায় সর্বাপেক্ষা বেশি থাকে।
করপোরেট বন্ড
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো যে ধরনের বন্ড ইস্যু করে থাকে, সেগুলো করপোরেট বন্ড। এই বন্ড কোম্পানিগুলোর ব্যাংক ছাড়া টাকা উত্তোলনের একটি সেরা মাধ্যমে। এখানে কুপন রেট কম থাকলেও বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকে।
এজেন্সি বন্ড
সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো এই বন্ড ইস্যু করে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্টস লিমিটেড এবং বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ সরকারের ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করার পদ্ধতি
সুদ প্রদানের পদ্ধতির ভিত্তিতে বন্ডের শ্রেণীবিন্যাস নিম্নরূপ:
জিরো কুপন বন্ড
এই বন্ডগুলোতে কোনো সুদ বা কুপন দেওয়া হয় না তবে মেয়াদপূর্তিতে বন্ডের ফেস ভ্যালুতে মূল টাকা পরিশোধ করা হয়। প্রথমেই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে মেয়াদ শেষে প্রদানকৃত অর্থের পরিমাণ বা বন্ডের ফেস ভ্যালু ঠিক হয়। আর বন্ড ইস্যুর সময় এই ফেস ভ্যালুর থেকে কম মূল্যে বন্ড ছাড়া হয়। আর এই ডিস্কাউন্ট রেটটাই বিনিয়োগকারীদের লাভ।
কনভার্টিবল বা রূপান্তরযোগ্য বন্ড
এই করপোরেট বন্ডগুলোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময় পর বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারে পরিণত হতে পারেন। তুলনামূলক কম সুদ প্রদান করতে হয় বিধায় কোম্পানি কনভার্টিবল বন্ড ইস্যু করে। এমনকি এখানে বন্ড হোল্ডাররা শেয়ার হোল্ডারে পরিণত হওয়ায় নির্দিষ্ট সময় পর তাদের মূলধন ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা কোম্পানির থাকে না।
কল-এবল বন্ড
যে বন্ডের মেয়াদ উত্তীর্ণের পূর্বেই তার ইস্যুকারী নতুন করে সুদের হার ধার্য করতে পারে, তাকে কল-এবল বন্ড বলে। মেয়াদ চলাকালেই বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট কোয়ালিটি বৃদ্ধি পেতে পারে কিংবা বাজারে সুদের হার কমে যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি আগের থেকে কম কুপন রেট দিয়ে পুনরায় বন্ডটি ইস্যু করতে পারে। এতে ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের লাভ হয় এবং বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়।
পুট-এবল বন্ড
এখানে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই বন্ড হোল্ডাররা বন্ড ইস্যুকারীকে বন্ড বিক্রি করার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে। এতে করে বাজারে বন্ডের দর কমে যাওয়া অথবা সুদের হার বেড়ে যাওয়ার পূর্বেই বিনিয়োগকারীরা বন্ড বিক্রির সুযোগ পায়। এই সুবিধা থাকার জন্য পুট-এবল বন্ড বাজারে অন্যান্য বন্ড থেকে একটু বেশি মূল্যে বিক্রি হয়।
ইনকাম বন্ড
এটি অনেকটা জিরো কুপন বন্ডের মতো, তবে এখানে সুদ দিতে হয়। এই সুদ তখনই প্রদান করা হয় যখন প্রতিষ্ঠানের কাছে কুপন দেওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ আয় থাকে।
পারপিচুইটি বন্ড
এই বন্ডগুলোতে মূলত কোনো মেয়াদ নেই। বন্ডের মূলধন শোধ না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকাল ধরে বন্ড হোল্ডাররা নিয়মিতভাবে কুপন বা সুদ পেয়ে যাবেন।
জামানতযুক্ত বা সিকিউরড বন্ড
এই বন্ড বিক্রির সময় ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা স্বরূপ একটি স্থায়ী সম্পদের দলিল বন্ধক রাখা হয়। জামানতযুক্ত বন্ডের ইস্যুকারী কোনো কারণে ঋণ খেলাপি হলে ঐ বন্ধককৃত সম্পদ বিক্রি করে বিনিয়োগকারীদের মূলধন সুদসহ ফেরত দেওয়া হয়।
জামানতবিহীন বা আন-সিকিউরড বন্ড
এই বন্ড বিক্রির সময় কোনো কিছু বন্ধক রাখার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বন্ড ক্রয়ের জন্য ক্রেতাকে কোম্পানির আয়, সুনাম এবং ঋণ প্রদানের ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে হয়।
এখানে প্রতিষ্ঠান কোনো কারণে ঋণ খেলাপি হলে বন্ড হোল্ডারদের স্বাভাবিকভাবেই সম্পূর্ণ মূলধন হারানোর ঝুঁকি থাকে।
আরও পড়ুন: ডলার এনডোর্সমেন্ট কী, কীভাবে করবেন