আগুনের ব্যবহারের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিলো মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ। কিন্তু শক্তির এই উৎসটিই হতে পারে মানুষের প্রাণনাশের কারণ। এর ভয়াবহতার পরিধি অবলোকন করা যায় ইতিহাস জুড়ে ধ্বংস যজ্ঞগুলোর দিকে ফিরে তাকালে। তাছাড়া সভ্যাতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে নিয়ন্ত্রণহীনতা, অসাবধানতা ও অপপ্রয়োগের ঘটনা। ফলশ্রুতিতে, বহু উপকারের এই শক্তির উৎসটির কবল থেকে বাঁচার জন্য বের করতে হচ্ছে নানা উপায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘন ঘন আগুন লাগার দুর্ঘটনাগুলোর কারণে আগুন নেভানোর উপায়গুলো জানা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলুন, এই দুর্ঘটনাগুলোর সম্ভাব্য কারণসহ জেনে নেই বিভিন্ন ধরণের আগুন নেভানোর উপায়সমূহ।
আগুনের উৎপত্তির সাধারণ কারণ সমূহ
পুড়ে ছাই বা কয়লা হওয়া জিনিস
কাঠ, বাঁশ, প্লাস্টিক, কাগজ, পোশাক, মোমবাতি ও আবর্জনার মত কঠিন দাহ্য বস্তুগুলো এই ক্যাটাগরির অন্তর্ভূক্ত। এগুলো থেকে সৃষ্ট আগুন খুব সাধারণ এবং প্রাথমিক বা ক্ষুদ্র পরিসরে এগুলো তেমন ঝুঁকিপূর্ণ হয় না। খুব ছোটখাট ব্যাপার থেকে এই আগুনের সৃষ্টি হয়। ইতোমধ্যে কয়লা বা ছাই হওয়ার জিনিসের সংস্পর্শে কোন দাহ্য বস্তু আসাও অগ্নিকাণ্ড সৃষ্টির কারণ হতে পারে। এই ক্যাটাগরির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ড হলো বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট আগুন।
মানুষের চলাচলের বাইরে বড় ডাস্টবিনে সৃষ্ট হওয়া আগুন ক্ষতির কারণ হয় না। অনেক সময় আপনাতেই নিভে যায় বা কেউ খুব সহজে নিভিয়ে দেয়। তবে এক জায়গায় বিভিন্ন ধরনের উপাদান থাকায় এখানে দীর্ঘক্ষণ ধরে জ্বলতে থাকা আগুন পরবর্তীতে লেলিহান শিখার জন্ম দিতে পারে। বাসা-বাড়ির চুলা বা গ্রামাঞ্চলের মাটির চুলার আগুনের সঙ্গে অন্য কোন দাহ্য বস্তুর সংস্পর্শ থেকে ছড়ানো আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
আরও পড়ুন: এটিএম বুথে কার্ড আটকে গেলে কি করবেন ? এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
তেল ও তেলজাত তরল
তেল থেকে সৃষ্ট আগুনের নেপথ্যে থাকে আলকাতরা, অ্যালকোহল, পেট্রোলিয়াম গ্রীস, পেইন্ট বা তেলজাত রং, পেট্রল, ও কেরোসিন। এগুলো থেকে সৃষ্ট আগুন যে কোনও জায়গায় লাগতে পারে। তবে গুদাম ঘরের মতো জায়গায় যেখানে একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণে দাহ্য তরল থাকে এমন জায়গায় অধিকাংশ অগ্নিকান্ড ঘটে।
আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনগুলোর রান্নাঘরে ব্যবহৃত তেলেরও কখনো কখনো মারাত্মক রূপ দেখা যায়। দীর্ঘক্ষণ রান্না করতে গিয়ে তেল চর্বি থেকে অঘটন ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে গ্রীস, লার্ড, অলিভ অয়েল, মাখন, পশুর চর্বি এবং উদ্ভিজ্জ চর্বি বেশ বিপজ্জনক। অনেক সময় এগুলোর কারণে রেস্তোরাঁগুলোতে চুলা, ওভেন বা গ্রিলে স্ফুলিঙ্গ থেকে ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
গ্যাসীয় পদার্থ
বিউটেন, গ্যাসোলিন, মিথেন এবং প্রোপেন গ্যাস কোন নগ্ন শিখা বা ইগনিশনের উৎসের সঙ্গে মিলিত হয়ে মারাত্মক আগুন সৃষ্টি করতে পারে। আগুন চারপাশ অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে বিধায় এটি আগুন লাগার শীর্ষকারণগুলোর মধ্যে একটি।
আরও পড়ুন: ৮৫ ঘণ্টা পর নিভল চট্টগ্রামের কন্টেইনার ডিপোর আগুন
গৃহস্থালি কাজে চুলার গ্যাস-পাইপ লিক এবং সিলিন্ডার থেকে আগুন লাগার ঘটনাগুলো বাংলাদেশে খুব দেখা যায়। এছাড়া ফ্যাক্টরিগুলোতে বিশাল সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনাও দুর্লভ নয়।
বৈদ্যুতিক গোলযোগ
পুরনো বা ক্ষত-বিক্ষত বৈদ্যুতিক তার, ঘর-বাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, পুরানো যন্ত্রপাতি জরাজীর্ণ সার্কিট ব্রেকার বক্স বা ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি, অতিরিক্ত চাপযুক্ত সার্জ প্রোটেক্টর প্রভৃতি এই ধরনের আগুন লাগার মূল কারণ।
ট্রান্সফরমার ও মোটর জনিত বিস্ফোরণ আবাসিক ও বাণিজ্যিক উভয় এলাকাতেই দেখা যায়। ত্রুটিপূর্ণ ওয়্যারিং অনেক দিন ধরে রেখে দেয়ার দরুণ ছোট শিখা থেকেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটতে পারে।
আরও পড়ুন: রাতে হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় প্রয়োজনীয় কিছু সতর্কতা
ধাতব পদার্থ
পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জির্কোনিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম, টাইটেনিয়াম, ও লিথিয়ামের মতো ধাতুগুলো থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তবে এই আগুন তৈরির জন্য অতিরিক্ত উচ্চ মাত্রার তাপ প্রয়োজন। তাই এই দুর্ঘটনাগুলো সাধারণত পরীক্ষাগার এবং বড় ফ্যাক্টরিগুলোতে দেখা যায়। এগুলোর অধিকাংশই ক্ষারীয় ধাতু, যা বাতাস বা জলের সংস্পর্শে এলে আগুন ধরে যায়। ধাতব পদার্থগুলোর গুঁড়োও বেশ মারাত্মক আকারের লেলিহান অগ্নিশিখা সৃষ্টি করতে সক্ষম।
বিভিন্ন ধরনের আগুন নেভানোর উপায়
নিরবচ্ছিন্ন পানির প্রবাহ
পানি আগুনের তাপ সরবরাহের পথে বাধা সৃষ্টি করে। এখানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো থেকে বের হওয়া পানির চাপ অনেক বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে জনসাধারণের জন্য যে বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত তা হলো, পানি শুধু পুড়ে ছাই হওয়া বা কয়লা হওয়া থেকে উদ্ভূত আগুন নেভাতেই বেশি কার্যকর। আগুন লাগার অন্য উৎসগুলোতে পানি তো কাজ দেয়ই না বরং উল্টো ক্ষয়-ক্ষতি আরও বাড়িয়ে তোলে।
আরও পড়ুন: চকবাজারে প্লাস্টিক কারখানায় আগুন
তেল জাতীয় উপাদান থেকে সৃষ্ট আগুনের ক্ষেত্রে পানি জ্বলন্ত উপাদানটিকে নেভানোর পরিবর্তে আরও ছড়িয়ে দেয়। বৈদ্যুতিক আগুন নেভানোর জন্য পানি ব্যবহার করা রীতিমত বিপজ্জনক, কারণ পানি বিদ্যুৎ সুপরিবাহী। বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে সৃষ্ট আগুনে পানি দিলে ব্যক্তির নিজেরও বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ অবস্থায় সর্বপ্রথম বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করে লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হওয়ার পরেও নিরাপদ দূরত্বে থেকে পানি দেয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে পানির ছিটা যেন শরীরের কোন অংশে না লাগে।
কখনো কখনো পানি নির্বাপক যন্ত্রগুলো আগুনের তীব্রতা বাড়িয়ে তুলে আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। এটি রান্নার তেলের আগুনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ধাতব পদার্থের আগুন নেভাতে কখনই পানি ব্যবহার করা উচিত নয়। পানি কোন কোন ধাতুর সংস্পর্শে এলে আগুন ধরে যায়।
বস্তা বা ভারী কাপড়
ছাই বা কয়লা থেকে উদ্ভূত আগুন নেভানোর জন্য ভেজা বস্তা বা ভারি কাপড় ব্যবহার করা যেতে পারে। বস্তা বা ভারি কাপড় দিয়ে বাড়ি দিয়ে আগুনের হলকা দূর করা যেতে পারে। এভাবে প্রাথমিকভাবে গরম বাতাস বন্ধ করা যায়।
আরও পড়ুন: সিলেটে হকার্স মার্কেটে আগুন নিয়ন্ত্রণে
সিলিন্ডার অগ্নিকাণ্ডে সিলিন্ডারের অগ্নিমুখে ভেজা কাঁথা ও কম্বল দিয়ে চাপ দিয়ে বা নব ঘুরিয়ে পানির জোর ঝাপটা দিতে হবে। তেলের আগুনেও ভেজা বস্তা বা কাঁথা কাজ দিতে পারে।
পেট্রল বা ডিজেলের মতো তেলের আগুন যদি ক্ষুদ্র পরিসরে হয়, তবে বস্তা বা কাঁথার মতো ভারি কাপড় দিয়ে আগুন ঢেকে দেয়া যেতে পারে।
বালু
কাঠ কয়লা, চুলার আগুন থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে শুকনো বালি ব্যবহার করা যেতে পারে। ধাতব পদার্থের আগুনে শুকনো বালি দিয়ে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বালুর ছিটা তেলের আগুন বশে আনতে সাহায্য করে। পেট্রল বা ডিজেল থেকে লাগা ক্ষুদ্র আগুনে বালির নিক্ষেপ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
আরও পড়ুন: এয়ার কন্ডিশনার ছাড়াই গরমে ঘর ঠান্ডা রাখার কার্যকরী উপায়
কার্বন-ডাই-অক্সাইড
চাপযুক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্বাপক যন্ত্র তেল বা গ্যাস থেকে সৃষ্ট আগুনের ক্ষেত্রে দারুণ কাজ দেয়। কার্বন ডাই অক্সাইড বিদ্যুৎ অপরিবাহী বিধায় বৈদ্যুতিক আগুনের শিখা দমনে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। রাসায়নিক পদার্থ থেকে উদ্ভূত আগুন প্রাথমিকভাবে পানির কুয়াশা তৈরি করে আগুন নেভানো যায়। তবে এক্ষেত্রে কার্বন ডাই-অক্সাইড-ই সবচেয়ে ভালো কাজ করে।
শুষ্ক পাউডার
বৈদ্যুতিক আগুন নেভানোর জন্য শুকনো পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো মূলত মনো অ্যামোনিয়াম ফসফেট বা এবিসিই শুষ্ক পাউডার। শুকনো পাউডার নির্বাপক যন্ত্রগুলো অক্সিজেন থেকে জ্বালানী আলাদা করে বা আগুনের তাপ উপাদানকে সরিয়ে দেয়। এই পাউডারগুলো একটি আদর্শ নির্বাপক।
গ্রাফাইট পাউডার, গুঁড়ো তামা এবং সোডিয়াম ক্লোরাইড শুকনো পাউডারের শক্তিশালী এজেন্ট হিসাবে স্বীকৃত। শুষ্ক পাউডারের তাপ শোষণ প্রভাব সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত রাসায়নিক পদার্থের আগুন নেভানোর জন্য। তবে এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, এজেন্টগুলো যেন রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়ায় আগুন তৈরিতে সহায়ক না হয়।
আরও পড়ুন: সরিষাবাড়ী ইউএনও কার্যালয়ে আগুন, নথিপত্র পুড়ে ছাই
বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার পর বৈদ্যুতিক গোলযোগের সৃষ্ট আগুনেও শুকনো পাউডার ব্যবহার করা যায়। গ্যাস থেকে উদ্ভূত আগুনের ক্ষেত্রেও একইভাবে এই পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে।
সাবানের ফেনা বা ফোম
কয়লা বা ছাই থেকে সৃষ্ট আগুন পানির পাশাপাশি সাবানের ফেনা বা ফোম দিয়ে নেভানো যায়। এটি শুধু আগুন নিভিয়েই দেয় না, সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ হ্রাস করতে সহায়তা করে। তেল জাত পদার্থের আগুনে শুধু ফেনা ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু এক্ষেত্রে সাবানের ফেনা বা ফোম একটু দেরিতে কাজ করে।
তবে বৈদ্যুতিক আগুন নেভানোর জন্য এই ফেনা বা ফোম সঠিক নির্বাচন নয়। কেননা পানির মত এটিও বিদ্যুৎ পরিবাহী। ধাতব ও রাসায়নিক পদার্থ থেকে অগ্নিকান্ডের আগুনের ক্ষেত্রে ফোমের প্রভাব নেতিবাচক।
আরও পড়ুন: ঈদের ছুটিতে ভ্রমণের পূর্ব প্রস্তুতি এবং দুর্ঘটনা এড়াতে কিছু সতর্কতা
শেষাংশ
আগুন লাগা থেকে বাঁচতে এ ধরনের দুর্ঘটনাগুলোর পেছনের কারণগুলো থেকে পরিত্রাণে পূর্ব সতর্কতার কোন বিকল্প নেই। কেননা এই দুর্ঘটনাগুলোর আকস্মিকতায় সম্বিত ফিরে পাবার আগেই অনেক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। উপরোক্ত উপায়গুলো এই ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণটা বেশ কমিয়ে আনতে পারে। এ বিষয়গুলো আয়ত্ত্বে থাকলে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর সময়টুকুতে যথাসাধ্য ব্যবস্থা নেয়া যায়। এ অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রেখে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হলেও যারা আগুন থেকে মোটামুটি নিরাপদ অবস্থানে আছেন তাদেরকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো সংগ্রহ করতে হবে। পাশাপাশি এগিয়ে যেতে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে।
তবে মনে রাখতে হবে যে সব ধরণের আগুন নেভানোর পদ্ধতি এক নয়। একেক ধরেন আগুন নেভাতে একেক পদ্ধতি কার্যকর। ভুল উপায়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলে আগুন নিভে যাওয়ার পরিবর্তে আরো বেড়ে যেতে পারে। আগুন কিভাবে নেভাবেন তা অনেকাংশে নির্ভর করে আগুনের উৎপত্তির কারণের উপর। তাই আগুন কিভাবে লেগেছে সেটা জেনে সতর্কতার সঙ্গে অগ্নি নির্বাপক পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি।
আরও পড়ুন: নাটোরে চলন্ত পিকনিক বাসে আগুন