নিজের প্রিয় কাজটি করার পাশাপাশি কর্ম জগতে নিজের আলাদা একটি পরিচয় তৈরি করার সেরা উপায় হলো শিল্পচর্চা। আর যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে বর্তমানের সর্বাধিক পরিশীলিত শিল্পগুলোর দিকে আলোকপাত করতে গেলে অকপটেই বলা যায় রন্ধনশিল্পের কথা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেই এখন নিজেদের ক্যারিয়ার গঠনে বেছে নিচ্ছে এই প্রাচীন শিল্পটিকে। যাদের মধ্যে ইতোমধ্যে এর অঙ্কুর রয়েছে তাদের জন্য রীতিমত আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা জায়গার যোগান দিচ্ছে এই সার্বজনীন পেশাটি। ফলশ্রুতিতে দেশ জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক রান্নার স্কুল। চলুন, জেনে নেয়া যাক ঢাকার কয়েকটি সেরা রন্ধন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ব্যাপারে।

ঢাকায় রান্না শেখার ১০টি স্কুল

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট অব কালিনারি আর্টস (আইটিআইসিএ)

রন্ধনশিল্পে অধ্যয়নের নিমিত্তে প্রথমেই বলা যেতে পারে এই প্রতিষ্ঠানটির কথা। বনানীর নাম ভিলেজে অবস্থিত এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিতে সুযোগ আছে ফুড অ্যান্ড বেভারেজ প্রোডাকশন বিভাগের উপর বিশদ প্রশিক্ষণের। আছে স্বল্পমেয়াদি কোর্স মাল্টি ক্যুজিন ছাড়াও আছে স্বল্প পরিসরে বিভিন্ন মেয়াদের সার্টিফিকেট কোর্স। এগুলোর মধ্যে ‘বেকিং ও পেস্ট্রি প্রোডাকশন-এর তিন মাসের সার্টিফিকেট কোর্সটি অন্যতম। এছাড়াও ৯ মাসের প্রফেশনাল শেফ কোর্সটি পেশাদার শেফ হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে সহায়ক হতে পারে। পরিসরের উপর নির্ভর করে কোর্সগুলোর খরচ পড়তে পারে ১০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা।

পড়ুন: বিদেশি ভাষা শিক্ষা: যে ভাষাগুলো উন্নত ক্যারিয়ারে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে

বাংলাদেশ হোটেল ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট (বিএইচএমটিটিআই)

নূন্যতম ১ মাস থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩ বছরের রান্না প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম আছে এই রন্ধন বিদ্যাপীঠে। পান্থপথের নিকটেই গ্রীন রোডে অবস্থিত এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সুযোগ আছে বিভিন্ন ক্যাটাগরির সার্টিফিকেট কোর্স। সেগুলোর মধ্যে ফুড অ্যান্ড বেভারেজ প্রোডাকশন শেফ এবং বেকারি কোর্স নামের জয়েন্ট প্রোগ্রামটি রন্ধন শিল্পে আগত নতুনদের জন্য উপযুক্ত হতে পারে। তাছাড়া খুব সময়ের মধ্যে ছোট-খাট রান্নায় হাতেখড়ি নেয়ার জন্য করে নেয়া যেতে পারে এক মাসের বেকারি এবং পেস্ট্রি কোর্সটি। যারা রান্না নিয়ে বেশ সিরিয়াস তাদের জন্য অ্যাডভান্সড ডিপ্লোমা ইন কালিনারি, বেকিং এবং পেস্ট্রি আর্টস অথবা ফুড প্রিপারেশন এবং কালিনারি শেফ কোর্সটি উৎকৃষ্ট হতে পারে।

এই প্রোগ্রামগুলোতে খরচ পড়তে পারে নিম্নে ৯০ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত। স্বল্প মেয়াদি সার্টিফিকেট কোর্সগুলোর ফি ১২ থেকে ৪০ হাজার টাকা।

পড়ুন: মধু কি সত্যি অমৃত?

রিজেন্সি হসপিটালিটি ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট (আরএইচটিআই)

রিজেন্সির ১ বছর মেয়াদি পেশাদার কুকারি প্রোগ্রামটি বেশ জনপ্রিয়। ক্ষিলক্ষেতের নিকুঞ্জে অবস্থিত এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির স্পেশাল কোর্সের মধ্যে আছে বাটলারের প্রশিক্ষণ ও প্রফেশনাল বারিস্তা। এছাড়া

স্কিল টেস্ট সার্টিফিকেশন প্রোগ্রামটির মাধ্যমে রন্ধনশিল্পীরা নিজেদের দক্ষতাকে যাচাই করে নিতে পারেন। সার্টিফিকেট কোর্সগুলোতে রন্ধনশিল্পে আগ্রহীদের জন্য আছে পেস্ট্রি ও বেকারি এবং ফুড প্রোডাকশন কোর্স। আর প্রফেশনাল কুকারির ডিপ্লোমা কোর্সটি উন্নত ক্যারিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিভিন্ন মেয়াদের উপর ভিত্তি করে এখানকার প্রোগ্রামগুলোতে খরচ পড়তে পারে ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।

পড়ুন: অনলাইনে গ্যাস বিল পরিশোধ করার নিয়ম

ইয়েস ট্যুরিজম এ্যান্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট (ওয়াইটিএইচএম)

বাংলাদেশ টেকনিক্যাল এডুকেশন বোর্ড-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ইতোমধ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। এই ট্রেনিং সেন্টারটি ধানমন্ডির ২৭ নাম্বারের জেবুন টাওয়ারে অবস্থিত। এর কোর্সগুলো ভোকেশনাল ও সার্টিফিকেট এই দুই ভাগে বিভক্ত। ভোকেশনালগুলো স্বল্প মেয়াদি আর সার্টিফিকেট কোর্সগুলো দীর্ঘ মেয়াদি। তন্মধ্যে পেস্ট্রি ও বেকারি প্রোগ্রামটিতে এই দুই ক্যাটাগরি ছাড়াও আছে তিন মাসের একটি অ্যাডভান্সড কোর্স। সার্টিফিকেট প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে ১ বছরের সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম ইন ফুড এ্যান্ড বেভারেজ প্রোডাকশন (প্রফেশনাল শেফ কোর্স) প্রোগ্রামটি রন্ধনশিল্পীদের ক্যারিয়ারের জন্য সেরা নির্বাচন হতে পারে।

এখানে স্বল্প মেয়াদের কারণে ভোকেশনাল কোর্সগুলোর খরচ স্বভাবতই কম; ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আর দীর্ঘ মেয়াদি সার্টিফিকেট কোর্সগুলোতে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা লাগতে পারে।

পড়ুন: নিপা ভাইরাস এড়িয়ে খেজুর রস খাওয়ার উপায়

ন্যাশনাল হোটেল এ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট (এনএইচটিটিআই)

বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন-এর আওতাধীন এই প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত মহাখালিতে। রন্ধনশিল্পের প্রসারের লক্ষ্যে এই জাতীয় উদ্যোগটি ইতোমধ্যে হাজার হাজার রন্ধন কর্মী তৈরি করেছে। এখানে প্রফেশনাল শেফ কোর্স, প্রফেশনাল বেকিং কোর্স-এর পাশাপাশি আছে কালিনারি আর্ট্স ও কেটারিং ব্যবস্থাপনায় ডিপ্লোমা কোর্স। শুধুমাত্র এসএসসি পাশ যোগ্যতাতেই যে কোন বয়সের লোকেরাই সফলতার সাথে এই কোর্সগুলো সম্পন্ন করতে পারছে। এখানে রান্না শেখার প্রোগ্রামগুলোর সময়সীমা নিম্নে ১০ মাস থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১ বছর পর্যন্ত। খরচ পড়তে পারে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

ইন্সটিটিউট অব ট্যুরিজম অ্যান্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট (আইটিএইচএম)

উন্নত বিশ্বে দেশের মান সমুন্নত রাখার নিমিত্তে রন্ধনশিল্পে দক্ষ মানব-সম্পদ গড়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর এই প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানটি। বেকারি আইটেম তৈরির সাথে সাথে পুরোদস্তুর শেফ হয়ে ওঠার জন্য ধানমন্ডির ১৬ নাম্বার রোডের এই প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে দক্ষ মেন্টোর। ফুড অ্যান্ড বেভারেজ প্রোডাকশন-এ জেনারেল কোর্স-এর পাশাপাশি আইটিএইচএম-এর ডিপ্লোমাগুলো রন্ধনশিল্পে যে কোন উদ্যোগ গ্রহণে সফল পদক্ষেপে সাহায্য করে। জেনারেল কোর্সগুলোতে ৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা নেয়া হয়ে থাকে। আর এদের সর্বাধিক গৃহীত ডিপ্লোমা ইন প্রোফেশনাল শেফ প্রোগ্রামের সম্ভাব্য খরচ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা।

পড়ুন: লবঙ্গের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা ও ঝুঁকি

বাংলাদেশ স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট

রন্ধনশিল্প কেন্দ্রিক কর্মক্ষেত্রে বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেশ স্বনামধন্য ড্যাফোডিল গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানটি। এখানকার প্রোগ্রামগুলোর মাধ্যমে খুব কম সময়ের মধ্যেই এবং প্রফেশনাল ভাবে ফুড এ্যান্ড বেভারেজ প্রোডাকশন এবং হসপিটালিটি কেটারিং এ্যান্ড কুকিং রপ্ত করা যায়। রান্নার তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতোমধ্যে এই কোর্স দুটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ব্যবহারিক ক্লাস ছাড়াও এখানে ক্যারিয়ারের জন্য সহায়ক সেমিনারের আয়োজন হয়ে থাকে যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজের নতুন সুযোগের সৃষ্টি হয়। এর অবস্থান ধানমন্ডি ১২ ও ১৩ নাম্বার রোডের মাঝে মিরপুরগামী প্রধান সড়ক সংলগ্ন এলাকায়। এই কোর্সগুলোতে খরচ পড়ে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা।

আপন ঘর কেটারিং এ্যান্ড কালিনারি ইন্সটিটিউট

এবার বড় বড় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের বাইরে বৈচিত্র্যপূর্ণ দারুণ কিছু রান্না শেখার প্ল্যাটফর্ম সম্বন্ধে জানা যাক। সার্টিফিকেটের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো একদম ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ রন্ধনশিল্পী গড়ে তুলছে সেগুলোর মধ্যে আপন ঘর সেরা। লালমাটিয়ার ব্লক বি তে অবস্থিত এই রান্না প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিতে ধরাবাধা কোন ডিপ্লোমা কোর্সের বদলে সরাসরি শেখানো হয় হরেক রকমের রান্না। যেমন- নানা পদের আচার, চিকেন কারি ও পরোটা, ফুচকা, আইসক্রি, কাবাব, কেক, মাছ ও বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন খাবার। দেশি খাবারের পাশাপাশি আছে অনেক ধরনের বিদেশি খাবার বানানোর সুযোগ। খাবারের ধরনের উপর ভিত্তি করে কোর্সগুলোতে খরচ পড়তে পারে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা।

পড়ুন: সুস্থ থাকতে কলা নয়, খোসা খান

রঙধনু একাডেমি

আপন ঘরের মত আরেকটি রান্নার শেখার জায়গা হচ্ছে মিরপুর-১০ এর এই রঙধনু একাডেমি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের রকমারি খাবার বানানোয় দক্ষ হতে হলে ভর্তি হতে হবে এই একাডেমিতে। সবজি থেকে শুরু করে ভর্তা, মাংস ও মাছের যত ধরনের রান্না সবি মিলবে রঙধনুর রঙিন প্রোগ্রাম সম্ভারে। দেশিয় খাবারের প্রাধান্য থাকলেও একেবারে বাদ পড়ে যায়নি স্যুপ, পেস্ট্রি, চাইনিজ, ও নুডুল্স। এর মিষ্টিজাত খাবার তৈরির কোর্সগুলো সম্পন্ন করতে পারলে বছরের বিশেষ দিনগুলোতে বিশেষ খাবার বানানো নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।

রঙধনুর এই রান্না শিখতে খরচ পড়তে পারে সর্বনিম্ন ১৫০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০০০ টাকা।

পড়ুন: উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত খাবার ও জীবন ধারণ পদ্ধতি

গৃহসুখন

সফল নারী উদ্যোক্তা রিমা জুলফিকার গৃহসুখন হতে পারে রান্না শেখার একটি উপযুক্ত জায়গা। ধানমন্ডির গ্রীনরোড সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে খুব কম খরচেই শিখে নেয়া যেতে পারে রান্নার যে কোন ক্যাটাগরি। অতঃপর তার উপর ভিত্তি করে শুরু করা যেতে পারে রান্নার ক্যারিয়ার। কোর্স ভেদে ২৫০০ থেকে ৬০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে এখানে। মুলত বাঙালি ঘরোয়া খাবারের আইটেমগুলোকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় এখানে। বর্তমানে অনলাইনে হোম মেড খাবার অর্ডার নেয়া ও ডেলিভারি দেয়া একটি আকর্ষণীয় উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের ফুড বিজনেসের জন্য প্রস্তুতির শুরুটা হতে পারে গৃহসুখন থেকেই।

নিজের প্রিয় কাজের মাধ্যমে পরিচিত তৈরির লক্ষ্যে সৃজনশীলতা চর্চার কোন বিকল্প নেই। রান্না নিঃসন্দেহে সৃজনশীলতার একটি মোক্ষম অনুশীলন, যেটি যুগ যুগ ধরে গ্রাম-বাংলার গৃহিণীরা করে আসছেন। তবে এখন রান্নার সুবিস্তৃত ক্ষেত্রে তারা নিজেদের মেলে ধরতে পারছেন। সেই ধারাবাহিকতায় জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তারা। এরই ফলশ্রুতিতে ধারাবাহিকতা পাচ্ছে নতুন দক্ষ রন্ধনশিল্পী তৈরির কার্যক্রমগুলো।

পড়ুন: স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পিংক সল্ট বা হিমালয় লবণের উপকারিতা