ঝড়ের রাতে স্থানীয়রা অনেকটা জোর করেই তাকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যান। সকালে এসে দেখেন তার ঘর নেই। কল্পনা রানী নামের ওই নারী বলেন, ‘ঝড়ে ঘর তো নিছেই, ঘরের মাল-সামানা কিচ্ছু রেখে যায়নি। নতুন করে কোথাও যে থাকব তার কোনো উপায় নেই।’
বটিয়াঘাটা সড়ক দিয়ে দাকোপ উপজেলার দিকে যেতে পশুর নদ তীরের বেশির ভাগ বাড়িই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনই চিত্র দক্ষিণাঞ্চলের খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ এলাকার। সব মিলিয়ে এ অঞ্চলে এখন শুধু হাহাকার। এক দিকে ছিলো করোনার আতঙ্ক, এর মধ্যে আম্পানের আঘাত। এ যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। ঈদের আনন্দ সব ম্লান হয়ে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে খুলনায় ১০ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেছে। সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে ১২ হাজার ২৫৭টি ঘের ও পুকুর। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকা। বাগেরহাটে সাড়ে তিন শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে সাড়ে ৪ হাজারের অধিক মাছের ঘের। নষ্ট হয়েছে ১,৭০০ হেক্টর জমির ফসল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, ‘খুলনায় ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০ কিলোমিটার সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। বিধ্বস্ত হওয়া বাঁধের পুরোটাই কয়রা উপজেলায়। এছাড়াও দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা ও ডুমুরিয়া উপজেলায় আংশিক ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।’
কয়রা উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত মোস্তাজিবুল হক জানান, প্রায় ১১ বছর আগের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার ক্ষত সারতে না সারতেই আম্পানের তাণ্ডবে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। গত ১০ বছরেও বাঁধ মেরামত হয়নি। টেকসই বাঁধ না হলে এখানে ভবিষ্যতে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়বে।
খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, কয়রা উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ১০ কিলোমিটার ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া আরও ৪০ কিলোমিটার বাঁধ ও ৫০ কোটি টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে।
সাতক্ষীরায় ১৭৬ কোটির মাছের ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে সাতক্ষীরায় ১২ হাজার ২৫৭টি মাছের ঘের ও পুকুর ভেসে গেছে। এতে মৎস্য খামারিরা ১৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের জলোচ্ছ্বাসে শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জের ১২ ইউনিয়নের ১৩ হাজার ৪৭৭ হেক্টর জমির ঘের পানিতে ভেসে গেছে। যাতে ১,৬৭৭ মেট্রিক টন সাদা মাছ এবং ২,৫৩১ মেট্রিক টন চিংড়ির ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী ও কালিগঞ্জ উপজেলার মৎস্য চাষিরা।
তিনি জানান, ঝড়ের আগে ১,৯০৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩ লাখ ৭০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ জন্য মৃত্যু কম হয়েছে। ঝড়ের আগে ৩৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। নতুন করে আরও ৩৭৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ঢেউ টিন ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে।
বাগেরহাটে ভেসে গেছে সাড়ে ৪ হাজার মাছের ঘের, নষ্ট হয়েছে ১,৭০০ হেক্টর জমির ফসল। সেই সাথে সাড়ে তিন শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘ঝড়ের আগেই উপকূলের অধিকাংশ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিলাম। কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।’