১৯৬১ সালে যাত্রা শুরু পূর্ব পাকিস্তান ভেটেরিনারি কলেজের। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ঘোষণা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে এই নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)।
মূলত এই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি পাকিস্তানের শোষণ, অবিচার, বাষট্টি’র শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলার এক নতুন সূর্যোদয় দেখা সকল কিছুরই স্বাক্ষী।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের তালিকায় নাম রয়েছে বাকৃবির কিছু সূর্য সন্তানদের। প্রজন্মের পর প্রজন্ম দল-মত নির্বিশেষে সবার জন্য তাদের স্মৃতি রক্ষার্থেই নির্মিত হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ’ বা ‘মরণ সাগর’।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয় মরণ সাগর, যা পরবর্তীতে উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আলী আকবরের (২০১৫-২০১৯ সময়কাল) পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মুক্তিযুদ্ধ স্থাপনা সংস্কার সম্পর্কিত কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে বর্তমান রূপে নিয়ে আসেন।
স্মৃতিস্তম্ভটিতে একটি সম্পূর্ণ পরিস্ফুটিত শাপলা ফুলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আছে দু’টি হাত, হাতের মধ্যে একটি রাইফেল উঁচু করে ধরা এবং রাইফেলের অগ্রভাগে বাংলাদেশের পতাকা বাধা। যা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশেকে অর্জনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন: বিশ্বসেরা গবেষকদের তালিকায় খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১ গবেষক
স্মৃতিস্তম্ভটির দেয়ালে খোদাই করে লেখা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বাকৃবির ১৯ জন শহীদের নাম। মরণ সাগরের লাল রঙয়ের সিঁড়ি ও মেঝে দ্বারা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে বোঝানো হয়েছে।
বাকৃবি হতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী শহীদদের মধ্যে শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী সকলেই রয়েছেন। শিক্ষকদের (১ জন) মধ্যে রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক এ.বি.এম আশরাফুল ইসলাম ভূঁইয়া। কর্মচারীদের (৬ জন) মধ্যে মো. আক্কাছ আলী, মধুসূদন বর্মন, মো. নুরুল হক, মো. গাজী ওয়াহিদুজ্জামান, মো. হাসান আলী ও গিয়াস উদ্দিন।
ছাত্রদের (১২ জন) মধ্যে - মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের মো. জামাল হোসেন, আব্দুল মতিন খন্দকার (টিপু) ও মনিরুল ইসলাম আকন্দ; কৃষি প্রকৌশল অনুষদের নাজির আখতার কাশেম ও আ.ন.ম নাজমুল আহসান; কৃষি অনুষদের হাবিবুর রহমান ও খুরশীদ আলম (শিবলী); ভেটেরিনারি অনুষদের আবুল কাশেম, কাজী মো. মঞ্জুর হোসেন ও ইব্রাহীম মোস্তফা কামাল; কৃষি অর্থনীতি অনুষদের মো. শামসুল হক তালুকদার ও মো. তহসীন আলী।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়েরিতে উল্লেখ রয়েছে- তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর শামসুল ইসলাম, সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. রফিকুল হক, প্রফেসর আতিয়ার রহমান মোল্লা, প্রফেসর ড. সাখাওয়াত হোসেন, প্রফেসর ড. শেখ জিনাত আলী, প্রফেসর ড. নূর মো. তালুকদার, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাবেক রেজিস্ট্রার মো. নজিবুর রহমানসহ ৮৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম।
শহীদ শিক্ষার্থীদের স্মরণে বাকৃবিতে ছাত্রদের জন্য নির্মিত ৩টি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে। মো. জামাল হোসেনের স্মরণে ১৯৮৮ সালের ১৩ অক্টোবর নির্মিত হয় শহীদ জামাল হোসেন হল। আ.ন.ম নাজমুল আহসানের স্মরণে ১৯৭৩ সালের ২৪ নভেম্বর নির্মিত হয় শহীদ নাজমুল আহসান হল। মো. শামসুল হক তালুকদারের স্মরণে ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের সভায় পূর্বের কায়েদে আযম হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদ শামসুল হক হল।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দেশ সেরা এই কৃষি শিক্ষার বিদ্যাপীঠে হাজার হাজার আগন্তুকদের মাঝে যুগের পর যুগ দেশ স্বাধীন করার কারিগরদের স্মৃতি প্রতিফলিত করবে মরণ সাগর। ধ্বনিত হবে – ‘মরণ সাগর পাড়ে তোমরা অমর তোমাদের স্মরি’।