উজানের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জির ভারী বৃষ্টিতে সুনামগঞ্জের নদ-নদী ও হাওরে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। রবিবার সকালে ঢলের পানি হাওরের পাড় উপচে তাহিরপুর উপজেলার বর্ধিত গুরমার হাওরে ঢুকছে। এতে হাওরের দুই হাজার হেক্টর জমির ফসল ঝুঁকিতে পড়েছে।
স্থানীয় কৃষকেরা জানিয়েছেন, এটা নতুন কোনো বাঁধ নয়, হাওরের পাড়ে পুরোনো স্থায়ী বাঁধ। গতকাল শনিবার রাতে হাওরে ব্যাপক পানির চাপ সৃষ্টি হয়। এরপর আজ সকালে বাঁধ উপচে হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করে।
হাওরপাড়ের গোলাবাড়ি গ্রামের কৃষক খসরুল আলম বলেন, যেভাবে পানি ঢুকছে, সেটি যদি সারা দিন অব্যাহত থাকে, তাহলে ফসলের ক্ষতি হবে। আর যদি পানির চাপ কমে যায়, তাহলে ফসল রক্ষা পাবে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বলেন, তাঁরা এ হাওরের ফসল রক্ষায় ১৫ দিন ধরে লড়াই করছেন। কৃষক, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্মকর্তা সবাই মিলে হাওরের বাগমারা এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধটির সংস্কারকাজ করছে। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় পাহাড়ি ঢলে পানির ব্যাপক চাপ বেড়ে রবিবার সকাল থেকে হাওরের উঁচু স্থান দিয়ে উপচে পানি ঢুকছে। এসব স্থানে বাঁধের প্রয়োজন হয় না। পানি আটকানোর চেষ্টা চলছে। লোকজন কাজে নেমে পড়েছেন।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানির উচ্চতা রবিবার দুপুর ১২টায় ছিল ৫ দশমিক ৮৭ মিটার। গত ২৪ ঘণ্টায় সুরমা নদীর পানি বেড়েছে ৪০ সেন্টিমিটার। এ ছাড়া জেলার সীমান্তবর্তী জাদুকাটায় এ সময়ে পানি বেড়েছে ৭১ সেন্টিমিটার, পাটলাই নদে ৪৩ সেন্টিমিটার।
সুনামগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১৩ মিলিমিটার। সুনামগঞ্জে উজানের পাহাড়ি ঢল নামা অব্যাহত আছে। এতে বাড়ছে নদ-নদী ও হাওরের পানি। এ অবস্থায় দ্রুত ধান কাটার চেষ্টা করছেন কৃষকেরা। কিন্তু অনেক হাওরেই ধান এখনও পুরোপুরি পাকেনি। সুনামগঞ্জে এবার প্রথম দফা পাহাড়ি ঢল নামে ৩০ মার্চ।
আরও পড়ুন: হাওরে স্থায়ী প্রকল্প গ্রহণ করা হবে: পানি সম্পদ উপমন্ত্রী
এখন দ্বিতীয় দফা পাহাড়ি ঢলেও ফসল বেশি ঝুঁকিতে আছে। উপজেলার সব নদ-নদীর পানি আবার বাড়ছে। এতে মাটিয়ান হাওর, গুরমার হাওর, শনির হাওর, মহালিয়া হাওর, সমসার হাওরের ফসল আবার ঝুঁকিতে পড়েছে।
একইভাবে এসব হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলোতেও পানির চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে টাক্সগুয়ার হাওরের বাঁধগুলো রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।
এ হাওরের মন্দিয়াতা গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক সানজু মিয়া বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই আবার ঢল নামছে। শনিবার পরিমাণটা বেশি ছিল। এতে হাওরে ঢেউ উঠছে। এ ঢেউ আছড়ে পড়ছে বাঁধে। এতে বাঁধে সমস্যা হচ্ছে।
একই হাওরপারের জয়পুর গ্রামের কৃষক মুজিবর রহমান বলেন, আমরা রাতে বাঁধে পাহারা দিচ্ছি। প্রশাসনের লোকজনও আমাদের সঙ্গে আছেন।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান করিব বলেন, হাওরে পানি বেড়েছে। ঢেউয়ের পানি বাঁধ উপচে গেছে। এতে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু ভাঙেনি। তবে অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বাঁধে পানির ব্যাপক চাপ বেড়েছে। সমস্যা হচ্ছে টাক্সগুয়ার হাওরের বাঁধগুলোকে নিয়েই। যেকোনো সময় যেকোনো বাঁধ ভেঙে যেতে পারে।
জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল আল আজাদ বলেন, আমরা একদিকে কৃষকদের বলছি ধান কাটতে, অন্যদিকে হাওরের বাঁধ রক্ষায় কাজ করছি। সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, জমিতে পাকা ধান রাখা যাবে না। ৮০ শতাংশ পাকলেই কেটে ফেলতে হবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, আজ থেকে উজানে ও ভাটিতে দুই স্থানেই বৃষ্টি কমবে। উজানের বৃষ্টি আমাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। ১৫ দিন ধরে মাটির বাঁধগুলো ঢলের পানির ব্যাপক চাপ সামলাচ্ছে। মাটি নরম হয়ে গেছে। অনেক বাঁধে ফাটল, ধস আছে। সেগুলোতে দিনরাত কাজ হচ্ছে। আমরা সবাই মিলেই চেষ্টা করছি। দুয়েকটা দিন ধরে রাখতে পারলে মনে হয় বিপদ কেটে যাবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে এবার দুই লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন।
এ পর্যন্ত ৩০ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। ধান কাটায় কৃষকদের পাশাপাশি হাওরে কম্বাইন্ড হারভেস্টর ও রিপার আছে।
সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলার ১২টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরে ৭২৭টি প্রকল্পে ১২২ কোটি টাকায় ৫৩৬ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারকাজ হয়েছে। এ বাঁধ নির্মাণকাজের সময়সীমা ছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সময় বাড়িয়েও বাঁধের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায়নি।