তিনি বলেন, ‘তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি আঁকুতি মিনতি করি। আল্লাহর কসম দেই। সন্তানের কসম দেই। প্রাণভিক্ষা চাই তাদের কাছে। এরপরও তারা ক্ষান্ত হচ্ছিলেন না। আমাকে বারবার কালেমা পড়তে বলছিলেন তারা। এসময় আরডিসি অকথ্য ভাষায় আমাকে গালিগালাজ করে।’
অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ দেয়া হবে এমন হুমকির পর, এভাবেই নিজের আকুতির কথা জানান সাংবাদিক আরিফুল।
তিনি আরও জানান, আটকের পর হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর এবং এর ভিডিও ধারণ করা হয়।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করা হচ্ছে: প্রতিমন্ত্রী
‘চোখ বাঁধা অবস্থায় আমার কাছ থেকে জোর করে ৪টি কাগজে স্বাক্ষর নেয়া হয়। পরে তাড়াহুড়ো করে আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আমাকে যে নির্যাতন করা হয়েছে তার আঘাতের চিহ্ন আমার শরীরে আছে’, বলেন আরিফুল।
জামিনের আবেদন করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি হাসপাতালে আসার আগ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে তা আমার অসম্মতিতে হয়েছে। আমাকে জোর করে করানো হয়েছে।’
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের বেডে থাকা অবস্থায় সাংবাদিকদের এসব কথা জানান আরিফুল ইসলাম রিগ্যান। বর্তমানে তিনি চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার রেদওয়ান ফেরদৌস সজিব জানান, আরিফুল ইসলাম বর্তমানে ভালো আছেন। তার শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। এসব রিপোর্ট হাতে আসলে প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে।
এদিকে রবিবার সকালে রিগ্যানের জামিন নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা। জামিনের কথা শুনে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে পূর্ব নির্ধারিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি ফেলে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ছুটে যান সাংবাদিকরা। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন সকাল সাড়ে ১০টায় সাংবাদিক আরিফুলের জামিন হয়েছে।
এ বিষয়ে আরিফুলের পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের জানান, আরিফুলের সম্মতিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে জামিনের জন্য আবেদন করা হয়। তার জামিন আবেদন অনুমোদনের পর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুজাউদ্দৌলার আদালতে জামিন আবেদনের শুনানিনী অনুষ্ঠিত হয়।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এসএম আব্রাহাম লিংকন এবং আরিফুলের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন ও অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু।
শুনানি শেষে ২৫ হাজার টাকার বন্ডে স্থানীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলুর জিম্মায় আরিফুলকে জামিন দেয়া হয় বলে জানা যায়।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামের সাংবাদিককে সাজা: ৫ তথ্য জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট
এর আগে শুক্রবার মধ্যরাতে আরিফুলকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বেধড়কভাবে পেটাতে পেটাতে ও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তাকে জেলা প্রশাসক অফিসে নেয়া হয়। সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় জামিন শুনানির পর দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হন সাংবাদিক আরিফুল।
এ বিষয়ে রিগানের বোন রিমা বলেন, আমরা কোনো কাগজে স্বাক্ষর করিনি, আপিলও করিনি। আমরা সম্পূর্ণ বিষয়টি তার অফিসের উপর ছেড়ে দিয়েছি। অফিসের লোকজনের পরামর্শে আমাদের আপিল করার কথা ছিল।
একই অভিযোগ করে রিগ্যানের মামা নবিদুল জানান, আমরা প্রয়োজনীয় নথিপত্র তুলতে ডিসি অফিসে যাওয়ার পর জানতে পারি তাকে (আরিফুল) জামিন দেয়া হয়েছে। কে বা কারা জামিন আবেদন করেছে তা আমাদের জানা নেই। পরিবারের পক্ষ থেকে জামিন চাওয়া হয়নি।
বাংলা ট্রিবিউনের ঢাকা ন্যাশনাল ডেক্স ইনচার্জ শাহ আলম সাংবাদিকদের বলেন, আরিফুলের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এখন যদি জোপূর্বক জামিন নেয়া হয়ে থাকে, তাহলে আমরা সম্পূর্ণরূপে এর বিরোধিতা করছি। এ বিষয়ে আমরা অফিসিয়ালি ব্যবস্থা নেব।
চলমান এ ঘটনায় জনপ্রশাসন বিভাগের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন কুড়িগ্রামে কর্মরত সাংবাদিকদের ধৈর্য ধারনের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পেলে সেটি পর্যালোচনা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকার কোনো অন্যায়ের পক্ষে থাকবে না।
সাংবাদিক আরিফুলের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে কুড়িগ্রাম শহর ও বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে।