তিনি বলেন, এখন দরকার এক নতুন বৈশ্বিকবাদ, এক অভিন্ন মানবতার নীতি যা কোনো একভাবে ঐক্য নয় বরং বিভক্তকারী ‘সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থের’ জায়গায় বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে।
শনিবার রাজধানীর সিক্স সিজন হোটেলে কসমস গ্রুপের জনহিতকর প্রতিষ্ঠান কসমস ফাউন্ডেশনের আয়োজনে কসমস সংলাপের অ্যাম্বাসেডর লেকচার সিরিজের আওতায় ‘পররাষ্ট্রনীতিতে মূল্যবোধ বা তার অনুপস্থিতি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এ কথা বলেন।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের প্রিন্সিপাল রিসার্চ ফেলো ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান।
প্রসিদ্ধ লেখক এবং কমনওয়েলথ অফ নেশনসের সাবেক উপ-মহাসচিব কৃষ্ণান শ্রীনিবাসান বলেন, এখনকার বসবাস এক ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়নের পৃথিবীতে। এখানে অবাধ্য সমস্যাগুলো কীভাবে সীমান্ত নির্বিশেষে মানবতাকে আক্রান্ত করছে তা তুলে ধরেন তিনি।
ভারতের সাবেক এ কূটনৈতিক বলেন, ‘সহনশীলতা, সমঅধিকার এবং সমসুযোগের ভিত্তিতে তৈরি একটি ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন মূল্যবোধ ব্যবস্থার মধ্যে সঙ্গতি থাকা উচিত।’
তবে, কিছু অসুবিধার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমাজে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করায় কাঙ্খিত সম্ভাবনাকে আপাতত অবাস্তব ও অসাধ্য করে তুলেছে।
শ্রীনিবাসান বলেন, মূল্যবোধগুলো গভীরতা এত বেশি যে এগুলোর প্রচার করা জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়।
তিনি বলেন, কখনও কখনও মূল্যবোধ, নৈতিক নীতিমালা, মতাদর্শগুলো সাধারণত পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তিতে হয় না। ‘এটি আমাদের বুঝতে হবে।’
শ্রীনিবাসন বলেন, মূল্যবোধ হলো আচরণের নীতি বা মানদণ্ড যা দ্বারা ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যাকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে।
ভারতীয় এ পন্ডিত বলেন, প্রজন্ম, শ্রেণি, শিক্ষার উৎস, ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে অবশ্যই মূল্যবোধগুলো আলাদা হতে পারে এবং তা জনগণ ও সরকার উভয়ের মানসিক পরিবর্তনের ফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
দেশীয় মূল্যবোধ এবং চর্চার কথা তুলে ধরে শ্রীনিবাসন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং যুক্তরাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষতা, সমানাধিকার, সামাজিক সম্প্রীতি এবং আইনের শাসনের বিষয়ে সার্বিক আলোকপাত করেন।
শ্রীনিবাসন বলেন, উন্নত বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে শরণার্থী, অর্থনৈতিক অভিবাসী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা অপ্রচলিত হলেও জার্মানিতে মূল্যবোধের অংশ হিসাবে শরণার্থীদের গ্রহণযোগ্যতার উপর জোর দিয়েছে। ‘প্রতিটি দেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে এর মূল্যবোধগুলোর নৈতিক মান রয়েছে।’
তিনি বলেন, আমাদের মূল্যবোধগুলো পরারাষ্ট্র নীতিতে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে যখন একটি দেশ তার শক্তি ও সামর্থ্য প্রদর্শন করার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠে।
শ্রীনীবাসন বলেন, পররাষ্ট্র নীতির আসল চালকগুলো অর্থনৈতিক বা কৌশলগত সুবিধার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
এক প্রশ্নের জবাবে শ্রীনীবাসন বলেন, ভারতে গণতন্ত্র বিনষ্ট হয়নি। আমি মনে করি ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেক শক্তিশালী।
ড. ইফতেখার তার বক্তব্যে বর্তমান সময়ে বিরাজমান কয়েকটি সমস্যার বিষয়ে আলোকপাত করেন এবং এ সমস্যাগুলো সমাধানের উপর জোর দেন।
বৈশ্বিক ও দেশের রাজনীতি কীভাবে পরিচালিত হয় সে সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন এক পৃথিবীতে জীবনযাপন করতে চেয়েছিলেন যা সংকীর্ণ ঘরোয়া প্রাচীর দ্বারা পৃথক নয় বলে জানান তিনি।
কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান বলেন, আজ তারা প্রত্যক্ষ করছে, পশ্চিমের যদি পতন নাও ঘটে, তবে অবশ্যই প্রাচ্যের উত্থান হবে। যাতে এশীয় শক্তি ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তারা যে মূল্যবোধগুলোর অনুশীলন করে সেগুলোর যথেষ্ট পরিমাণে আন্তর্জাতিকভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। তাহলে, বর্তমানের বিশ্ব রাজনীতি মূলবোধের কোন মান নির্ধারণ করে: পশ্চিমা, পূর্ব? নাকি দুয়ের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সার্বজনীন ঐকমত্য তৈরি করছে? প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এনায়েতুল্লাহ খান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ‘পপুলিজমের’ এক ধরনের উত্থান দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এ উত্থানের কারণে আমাদের এবং তাদের মধ্যকার পার্থক্যকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এটি অন্যথায় ভিন্ন ভিন্ন দেশের বিস্তৃতির গতিবেগ রোধ করছে বলে মনে হচ্ছে। কখনও কখনও তারা তাদের স্বতন্ত্র মূল্যবোধ এবং আদর্শকেও সমর্থন করে থাকে, বলেন তিনি।
খান বলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে এগুলো বিশ্বের স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। পর্যবেক্ষণ এবং অধ্যয়নের মাধ্যমে এগুলোকে ইতিবাচকভাবে সম্বোধন করতে হবে। সেই সাথে নেতিবাচক প্রভাবগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে।
সংলাপের একজন বক্তা জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্র নীতি ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়ে তিন বছরের অর্জন সম্পর্কে তুলে ধরেন।
ইউএনবি চেয়ারম্যান আমানুল্লাহ খান, পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞগণ ও সিনিয়র সাংবাদিকবৃন্দ এ সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।