ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স এই বছর বাংলাদেশকে ১৫২ তম স্থানে রেখেছে। বরাবরের মত এবারো ছিল মোট ১৮০ টি দেশ। হন্ডুরাসের পরে ৪৯.৭১ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুরস্কের ঠিক আগেই।
গত ২০ এপ্রিল রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সারণী থেকে এ তথ্যটি জানা যায়। এর কারণ দর্শানোর সময় তারা ‘কঠিনতর রাজনীতি’ শব্দটি উল্লেখ করেছিল। এছাড়াও, তারা কোভিড-১৯ মহামারির পরিণতির কথাও উল্লেখ করেছে। তারই সূত্র ধরে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও বেসামরিক সহিংসতার বিষয়টিও সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছে আরএসএফ। এভাবে, ৭৩ টি দেশে সাংবাদিকতা সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ বা গুরুতরভাবে প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হয়ে পড়েছে। বিষয়টি দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে কঠিনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কেননা এটি করোনাভাইরাসের মতোই ধ্বংসাত্মক।
আরও পড়ুন: জামিনে মুক্তি পেলেন প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইমলাম
এক নজরে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স
প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স মুক্ত সাংবাদিকতার ভিত্তিতে দেশগুলোর র্যাঙ্কিংয়ের একটি বাৎসরিক তালিকা। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার নামে একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা, সংক্ষেপে আরএসএফ, তালিকাটি সংকলন এবং প্রকাশ করে। সংগঠনটি ২০০২ সাল থেকে তথ্য স্বাধীনতা অধিকার রক্ষার লক্ষ্য নিয়ে তালিকাটি প্রকাশ করে আসছে। এরা মূলত ১৮০ টি দেশকে র্যাঙ্ক করে মুক্ত সাংবাদিকতার নীরিখে।
জরিপ প্রশ্নাবলী
আরএসএফ ৭ টি সাধারণ মানদণ্ড অনুসরণ করে ৮৭ টি প্রশ্নাবলি সমন্বিত একটি জরিপের মাধ্যমে ইনডেক্সটি তৈরি করে।
এগুলো হল- বহুত্ত্ববাদ (মিডিয়া জুড়ে মতামত), মিডিয়া স্বাধীনতা, পরিবেশ এবং স্ব-বিবাচন, আইনগত কাঠামো, স্বচ্ছতা, অবকাঠামো, গালাগালি।
জরিপের উত্তরদাতারা হলেন আরএসএফের অংশীদার প্রতিষ্ঠানসমূহ। এরা হলেন পাঁচটি মহাদেশের ১৮ টি বেসরকারি সংস্থার ১৫০ জন সংবাদদাতা যারা বিশ্ব জুড়ে স্বাধীন মত প্রকাশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাংবাদিক, গবেষক, আইনবিদ এবং মানবাধিকারকর্মীরাও এই জরিপে অংশ নেন।
আরও পড়ুন: সাংবাদিক রোজিনা অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবেন: সিএনএনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী
স্কোরিং
চূড়ান্ত স্কোরটি মূল্যায়নের জন্য আরএসএফ কর্মীরা প্রেস অপরাধের শিকার ও অপরাধী উভয়কেই পর্যবেক্ষণ করে। ভুক্তভোগীরা হলেন সাংবাদিক, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং মিডিয়া সহকারী, অন্যদিকে নাশকতাসমূহ আসতে পারে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী, গোপন সংস্থা বা ত্রাস সৃষ্টিকারী গ্রুপ থেকে।
আরএসএফ ২০ টি ভাষায় অনুবাদ করে জরিপ প্রশ্নগুলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে পাঠিয়ে দেয়। অতঃপর প্রাপ্ত উত্তরের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশকে স্কোর দেয়া হয়।
সবচেয়ে ভালো বুঝাতে শূন্য পয়েন্ট এবং সবচেয়ে খারাপের বুঝাতে ১০০ পয়েন্ট দেয়া হয় । তদনুসারে, আরএসএফের একটি রঙিন স্কোরিং পদ্ধতি রয়েছে যার মাধ্যমে দেশগুলোর প্রেসের স্বাধীনতার অবস্থানকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০২১ এর প্রথম সারির দেশগুলো হলো যথাক্রমে- নরওয়ে- ৬.৭২, ফিনল্যান্ড- ৬.৯৯, সুইডেন-৭.২৪, ডেনমার্ক - ৮.৫৭, কোস্টারিকা-৮.৭৬, নেদারল্যান্ডস- ৯.৬৭, জামাইকা - ৯.৯৬, নিউজিল্যান্ড - ১০.০৪, পর্তুগাল- ১০.১১, সুইজারল্যান্ড - ১০.৫৫।
অপরদিকে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০২১ এ সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো হলো যথাক্রমে- ইরিত্রিয়া - ৮১.৪৫, উত্তর কোরিয়া - ৮১.২৮, তুর্কমেনিস্তান - ৮০.০৩, চীন- ৭৮.৭২, জিবুতি - ৭৮.৬২, ভিয়েতনাম - ৭৮.৪৬, ইরান- ৭২.৭০, সিরিয়া - ৭০.৬৩, লাওস - ৭০.৫৬, কিউবা - ৬৩.৯৪।
বাংলাদেশের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স
৪০.১১ স্কোর নিয়ে ১৮০ টি দেশের ভীড়ে ১৫২ সংখ্যাটি মূলত বাংলাদেশী সাংবাদিকদের স্বাধীনতার অবস্থা প্রতিনিধিত্ব করছে। গত দশ বছরে, প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ চিত্রটি তুলে ধরা হলো যথাক্রমে-
২০১১- র্যাঙ্কিং ১১২
২০১২- র্যাঙ্কিং ১২৯
২০১৩- র্যাঙ্কিং ১৪৪
২০১৪- র্যাঙ্কিং ১৪৬
২০১৫- র্যাঙ্কিং ১৪৬
২০১৬- র্যাঙ্কিং ১৪৪
২০১৭- র্যাঙ্কিং ১৪৬
২০১৮- র্যাঙ্কিং ১৪৬
২০১৯- র্যাঙ্কিং ১৫০
২০২০- র্যাঙ্কিং ১৫১
গত বছর, করোনভাইরাস মহামারী এবং তাৎক্ষণিক লকডাউনের কারণে উদ্বেগজনকভাবে পুলিশ এবং বেসামরিক সহিংসতার বৃদ্ধি পেয়েছিল সংবাদমাধ্যমগুলো কেন্দ্র করে। মহামারী এবং সমাজে এর প্রভাব সম্পর্কে রিপোর্ট করার কারণে অনেক সাংবাদিক, ব্লগার এবং কার্টুনিস্টকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ ভার্চুয়াল সুরক্ষা আইনে "অপপ্রচার" এর জন্য কমপক্ষে চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ডের দণ্ডিত করা হবে। ফলস্বরূপ, স্ব-সেন্সরশিপটি অথবা স্ব-বিবাচনটি তুলনামূলকভাবে একটি অসামঞ্জস্য পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলো কারণ সম্পাদকরা কারাবাস বা তাদের মিডিয়া আউটলেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছিলো।
আশার বিষয় হলো, বাংলাদেশের মিডিয়া মার্কেটপ্লেসের জন্য দ্রুত উন্নতির একটি সম্ভাবনা আছে। কারণ অনেক অফলাইন ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যম শিল্পের অবদানে অংশ নিয়েছে এবং যা বর্ধমান বাজারে প্রভাব ফেলছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, বেসরকারী মালিকানায় থাকা বড় বড় বাংলাদেশী এজেন্সিগুলি মুল ধারায় চলে এসেছে। অতঃপর দেশব্যাপী প্রচুর মিডিয়া এখন দেশের অভ্যন্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলির নাগালের মধ্যে রয়েছে।
তাই প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের একটি সামঞ্জস্য অবস্থান ধরে রাখতে প্রয়োজন সুষ্ঠু আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধার সাথে মত প্রকাশের চর্চা।
আরও পড়ুন: ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স: এক ধাপ পিছিয়ে ১৫১তম স্থানে বাংলাদেশ
সমাপনী
ওয়াল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের নির্বিশেষে সমালোচনা সত্ত্বেও, তথ্যের প্রচলন শর্তহীন স্বাধীনতার দাবি করে। তবে এটি বলাই বাহুল্য যে, পেশাদার প্রতিবেদনের জন্য ন্যূনতম নৈতিকতা প্রয়োজন। অন্যথায়, জ্ঞান সত্যতার বাইরে চলে যেতে পারে। একজন সাংবাদিকের অবশ্যই তাকে প্রদত্ত ক্ষমতাটি যত্ন সহকারে পরিচালনা করা প্রয়োজন। একইভাবে, তাদের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে প্রতিটি সরকারী ও বেসরকারী মহলগুলোর স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসা উচিত। একমাত্র এ অবস্থাতেই সাধারণ মানুষ সত্যটা জানার আশা করতে পারেন।