ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের অধিকাংশ বড়, মাঝারি ও ছোট শহরগুলোই ভূমিকম্প দুর্যোগ মোকাবিলায় একেবারেই অপ্রস্তুত বলে মনে করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, শুক্রবার (২৮ মার্চ) মিয়ানমারে সংঘটিত ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতি ও আশপাশের দেশ ও অঞ্চলে তার সামগ্রিক প্রভাব আরও একবার বাংলাদেশের নগরগুলোর ভূমিকম্প প্রস্তুতি না থাকা এবং ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড এবং মহাপরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহার জোনিং না মানার প্রবণতার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট অনেকগুলো ভূমিকম্প বড় আকারের ভূমিকম্পের আসন্ন পূর্বাভাস দিলেও প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি প্রায় শূন্য। ফলে যেকোনো সময়ে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটার আগেই ভূমিকম্প-ঝুঁকি কমাতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে এখনই যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার আহবান জানিয়েছে আইপিডি।
সংস্থাটি বলেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করলেও দেশের পরিকল্পিত নগরায়ন, টেকসই আবাসন ও ভবনের নিরাপত্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো কমিশন করেনি। এ বিষয়টি তারা অনভিপ্রেত বলে মনে করে।
বিষয়টি আইপিডিসহ অনেকের কাছেই বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে ঢাকা মহানগরীতে যত্রতত্র নির্বিচারে বহুতল ভবন বানানোর স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের অনুমোদন করার জন্য সাতজন উপদেষ্টাকে নিয়ে ড্যাপ সংশোধনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করেছে। অথচ ভূমিকম্প কিংবা যেকোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগে মানুষের আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় এলাকাভিত্তিক পার্ক, খেলার মাঠ ও উদ্যানের মতো উন্মুক্ত স্থান কীভাবে নগরে বাড়ানো যায়, সেই আলোচনা সরকারি মহলে কোথাও শোনা যাচ্ছে না। তার ওপর কাঁঠালবাগান ও সংলগ্ন এলাকার জন্য দূর্যোগের সময়ে ঠাঁই নেওয়ার একমাত্র খোলা জায়গা পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষার্থে একশ দিনের সামাজিক আন্দোলনেও সরকার নির্লিপ্ত আচরণ করছে।’
আরও পড়ুন: ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে বাংলাদেশ, নির্দেশনা জারি
‘রাজউক এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনেকের বিরুদ্ধেই আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিভিন্ন আঁতাত করে দূর্নীতির মাধ্যমে যত্রতত্র অনুমোদনহীন ভবন গড়ে উঠতে দেওয়া এবং পরবর্তীতে মহাপরিকল্পনা সংশোধনের নামে সেইসব ভবন ও প্রকল্পের বৈধতা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই দূর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেটকে শনাক্ত করার এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং এই চক্রের সঙ্গে আপোষের মাধ্যমে রাজউক ও মন্ত্রণালয় ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ও ইমারত বিধিমালা সংশোধন করার সাম্প্রতিক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে ঢাকায় ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি আরও ব্যাপক হারে বাড়বে।’
সরু রাস্তায় বহুতল ভবন নির্মাণের অবাধ স্বাধীনতা কিংবা ১০ তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবনকে বহুতল বিবেচনা না করে কাঠামোগত ও অগ্নি নিরাপত্তায় ছাড় দেওয়ার উদ্যোগগুলো অত্যন্ত বিপদজনক উল্লেখ করে আপিডি জানিয়েছে, নাগরিক, পেশাজীবী ও পরিকল্পনাবিদদের পক্ষ থেকে এই বিষয়গুলোকে বারবার তুলে ধরা হলেও রাজউক ও মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করে আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।
আইপিডি আরও মনে করে, ‘ঢাকার ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনায় মাটির ভূতাত্ত্বিক গঠন ও গুণাগুণকে বিবেচনায় নিয়ে ভূমি ব্যবহার এবং ভবনের আকার-আয়তন নির্ধারণ করা প্রয়োজন। অথচ ঢাকার নগর পরিকল্পনায় এই বিষয়গুলোকে সেভাবে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে না।’
‘ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলসহ নগরীর চারদিকে বন্যা প্রবাহ অঞ্চল ও জলাশয়-জলাভূমি ভরাট করে অধিকাংশ অনুমোদনহীন যেসব আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে, সেখানে ইতোমধ্যেই অসংখ্য বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। দুর্বল মাটির ওপর গড়ে ওঠা এসব ভবনের ভূমিকম্প ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।’
‘সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের ভূমিকম্পেও এই প্রবণতা দেখা গিয়েছে। ঢাকার ড্যাপে এলাকাভিত্তিক ভিন্নতাকে মাথায় নিয়ে ভবনের আকার-আয়তন নির্দিষ্ট করার প্রস্তাবনা থাকলেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার সংশোধন প্রস্তাবনায় মন্ত্রণালয় এলাকাভিত্তিক ভিন্নতাকে বাদ দিয়ে পুরো ঢাকা মহানগরীর জন্য একইধরনের এফএআর বা ফার মান প্রস্তাব করেছে। পৃথিবীর কোনো শহরের নগর পরিকল্পনায় এ ধরনের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কৌশল না থাকলেও এভাবেই চলছে ঢাকার মত অত্যন্ত অবাসযোগ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ শহরের নগর পরিকল্পনা।’
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, এই ধরনের আত্ম-বিধ্বংসী প্রবণতা থেকে বের না হতে পারলে ঢাকার কাছাকাছি এপিসেন্টারে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। আমাদের নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের জনবসতির লোকজনের জন্যেও এই ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক আকারে হতে পারে, যা হাইতির ভূমিকম্পে দেখা গিয়েছিল।
আরও পড়ুন: ভূমিকম্পে মিয়ানমারে সহস্রাধিক প্রাণহানি, ব্যাপক মানবিক সংকট
এ অবস্থায় ঢাকাসহ দেশের নগর এলাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি কমাতে আইপিডি দশটি সুপারিশ করছে। সেগুলো হলো:
১) নগরে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ নিতে নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা কমিশন গঠন।
২) বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) বাস্তবায়নে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) গঠন করা।
৩) মাটির ভূতাত্ত্বিক গঠন ও গুণাগুণকে বিবেচনায় নিয়ে নগর এলাকার ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন।
৪) ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে ভবনের রেট্রোফিট বা শক্তি বৃদ্ধিকরণ ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভবন পূনর্নির্মাণ।
৫) নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মানুষের বসতি এলাকার ভবনগুলোর বৈশিষ্ট্য ও এলাকাভিত্তিক ভিন্নতাকে বিবেচনায় নিয়ে ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা কৌশল ও কর্মপন্থা নির্ধারণ।
৬) সরু রাস্তার পাশে এবং জলাশয়-জলাভূমির ওপর বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন না দেওয়া এবং গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন পরিষেবা লাইনগুলার নিয়মিত তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ।
৭) দূর্যোগের সময় আপৎকালীন আশ্রয়ের জন্য এলাকাভিত্তিক পার্ক, উদ্যান, খেলার মাঠ ও খোলা পরিসর তৈরি এবং সংরক্ষণ করা।
৮) মহাপরিকল্পনা ও ইমারত বিধিমালা, অগ্নি নিরাপত্তা সম্পর্কিত আইন প্রণয়নে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীস্বার্থে আপোষ না করে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সর্বোচ্চ প্রাধিকার দেওয়া।
৯) উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ভবন নির্মাণ ও পরিকল্পনা তদারকি সক্ষমতা বাড়ানো।
১০) ভূমিকম্প ঝুঁকি কমাতে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা।