মাগুরার শালিখা উপজেলার হাজরাহাটি এলাকায় চিত্রা নদীর পাড়ে অবস্থিত আটজন শহীদের গণ কবর। সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেয়ায় যে কোন সময় বিলীন হয়ে যেতে পারে এটি।
হাজরাহাটি গ্রামে অধির অধিকারীর বাড়ির দক্ষিণ পাশে চিত্রা নদীর তীরে এ গণ কবরটি অবস্থিত।
১৯৭১ সালে ৬ ডিসেম্বর রাতে স্থানীয় রাজাকাররা পাশের জুনারী গ্রাম থেকে আটজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে আসে। এ সমস্ত মুক্তিকামী মানুষ দেশের বিভিন্ন অংশ পাকিস্তান হানাদার মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি মহান বিজয় অর্জিত হচ্ছে এমন খবরে নিজেদের বাড়ি ফরিদপুরের বিভিন্ন গ্রামে ফিরে যাচ্ছিলেন।
রাজাকাররা তাদেরকে ধরে এনে পরদিন ৭ ডিসেম্বর চিত্রা নদীর পাড়ে প্রথমে বর্বর নির্যাতন করে। পরে নদীর পাড়ে হাত বেঁধে তাদের গুলি করে হত্যা করে। এরপর গ্রামবাসীকে দিয়ে নদীর পাড়ে তাদের গণ কবর দেয়া হয়।
এখানে শায়িত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন-যদুনাথ গুহ, পঞ্চানন পাল, হরিপদ দাস, নিত্যান্দন ভদ্র, মনোরঞ্জন দত্ত, নারুগোপাল রায়, সুরেশ কর ও অজ্ঞাত একজন।
এদের সবার বাড়ি ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী গ্রামে।
আরও পড়ুন: চলন্ত লঞ্চে আগুন: বরগুনায় গণকবরে অজ্ঞাত ২৩ লাশ দাফন
শালিখা উপজেলার হাজরাহাটি গ্রামের ছবি রাণী অধিকারী কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলেন, আজও আমি চিত্রা নদীর পাড়ে বসে আমার ভাই যদুনাথ গুহকে খুঁজে ফিরি। তার ছবিখানা হাতে নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে সেই গণকবরের কাছে যাই আর বলি- ফিরে আয় আমার ভাই, ফিরে আয় আমার ভাই।
ছবি রাণী বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর রাজাকাররা আমার ভাইসহ আরও সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। তারা শুধু তাদের হত্যাই করেনি বরং চোখ বেঁধে তাদের ওপর নির্মম অত্যাচার করে। তারপর একে একে হত্যা করে আটজন মুক্তিযোদ্ধাকে।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও তাদের এ গণকবর যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। বৃষ্টির ভরা মৌসুমে নদীতে যখন পানি ভরে যায় তখন গণকবরের সীমানায় পানি প্রবেশ করে। হয়তো আগামী দিনে এ গণকবর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
একই গ্রামের স্থানীয় রতন কুমার দাস বলেন, স্বাধীনতার সময় আমার বয়স ১৩ বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের গ্রামের রাজাকাররা মানুষের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার করে। নিরীহ মানুষকে ধরে তারা অত্যাচার করে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে চায়।
তিনি বলেন, যুদ্ধের শেষ সময়ে ভারত থেকে কিছু মুক্তিযোদ্ধা আমাদের গ্রাম দিয়ে তাদের নিজ জেলা ফরিদপুর জেলায় যাচ্ছিল। এ খবর রাজাকাররা পেয়ে তাদের লোকজন দিয়ে আটজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে আনে। তারপর চিত্রা নদীর পাড়ে তাদের চোখ বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করে চলে যায়। তখন গ্রামবাসীরা একটি কবর খুঁড়ে সেই কবরে আটজনকে মাটি চাপা দেয়।
আরও পড়ুন: কানাডার আরেকটি আদিবাসী স্কুলে গণকবরের সন্ধান
এছাড়া গণকবরটি নদীর পাড়ে হওয়ায় সেটি বিলীনের সম্মুখীন অবস্থায় রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমরা উপজেলা প্রশাসনকে বার বার তাগিদ দেয়ার পরও তারা কোন উদ্যাগ নেয়নি। শুধু কয়েকবার পরিদর্শন করে যায়। কিন্তু কোন সংরক্ষণের কাজ করে না। বিশেষ করে ভারী বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি ভরে গেলে গণকবরের কাছাকাছি উঠে যায়।
মাগুরা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা ইউনিটের যুগ্ম-আহ্বায়ক ও সাবেক যুদ্ধকালীন ডেপুটি কমান্ডার এস এম আব্দুর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর স্থানীয় রাজাকাররা ভারত থেকে ট্রেনিং করে ফিরে আসা আট মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে এনে চিত্রা নদীর পাড়ে চোখ বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরে এলাকার স্থানীয়রা তাদের গণকবর দেয়।
তিনি বলেন, আমরা কয়েকবার ওই স্থান পরিদর্শন করেছি এবং উপজেলার প্রশাসনকে বারবার তাগিদ দিয়েছে তা সংরক্ষণ করার জন্য। তাছাড়া আমরা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়গুলো দেখবাল করার জন্য অনুরোধ করেছি।
তিনি আরও বলেন, এ আট মুক্তিযোদ্ধার সবার বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। প্রতিবছর ৭ ডিসেম্বর ফরিদপুর বোয়ালমারী থেকে এ আট মুক্তিযোদ্ধার স্বজনরা ওই স্থানে এসে মিলিত হয় এবং অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
কিন্তু এবার কোন কারণবশত হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধারা দেশের প্রাণ তাদের প্রাণের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন করেছে। তাই তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব।
আরও পড়ুন: স্যাটেলাইট ছবিতে মারিউপোলের কাছে সম্ভাব্য গণকবরের সন্ধান