১৯৭১ সালের একজন যুদ্ধাপরাধীকে দেশে ফেরত পাঠানোর বাংলাদেশের অমীমাংসিত অনুরোধ স্থগিত করায় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিভাবের সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ নাগরিক এবং সিরিয়ায় গিয়ে এক ইসলামিক স্টেট (আইএস) যোদ্ধার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব বাতিল এর বিপরীত বলেও উল্লেখ করেন তারা।
যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠা শামীমা এখন তার নাগরিকত্ব বাতিলের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের একটি আদালতে লড়ছেন।
দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার পর যদি তার বাবা-মার আদি দেশ বাংলাদেশে পাঠানো হয় তাহলে তাকে সম্ভাব্য মৃত্যুদণ্ডের সম্মুখীন হতে হতো। একটি আদালত যা শুনেছে তাতে তিনি এখন কার্যকরভাবে রাষ্ট্রহীন।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যের ভিসা আবেদনের পেমেন্ট পদ্ধতির পরিবর্তন
শামীমার আইনি লড়াই সম্প্রতি সবার নজরে এসেছিল। কারণ বিশেষ অভিবাসন আপিল কমিশনে তার আপিলকে বলা হয়েছিল যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ ২০১৯ সালে শামীমা বেগমের যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব বাতিলের ‘গুরুতর পরিণতি’ বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
শামীমার নাগরিকত্ব বাতিলে সাজিদ জাভিদ তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর পাশাপাশি ১৯৭১ সালে চৌধুরী মঈন উদ্দিনের কর্মকাণ্ডকে ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধ বিবেচনা করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সরকার। যুক্তরাজ্য সরকারের এই ধারাবাহিক ‘দ্বিভাব’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিরোধীরা।
কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. অধ্যাপক একেএম জাকির হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়া ও হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পরও মঈন উদ্দিনের প্রত্যার্পণের জন্য বাংলাদেশের অনুরোধ যুক্তরাজ্য প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, এমনকি তারা মঈন উদ্দিন ও মানিলন্ডারিং মামলায় তারেকের রহমানের মতো দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিকে যারা আশ্রয় দিয়েছেন, আমাদের দেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলার নৈতিক অধিকার তাদের নেই।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জঘন্য গ্রেনেড হামলার দায়ে তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলা চালানো হয়েছিল।
এমনকি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলাটির বিষয়ে এফবিআইয়ের কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এছাড়া ২০১৩ সালে নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনের সময় অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১০০ জন মানুষকে হত্যার দায়েও অভিযুক্ত করা হয়।
শামীমার বিপরীতে মঈন উদ্দিনের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এখন বাংলাদেশে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাদের গণহত্যা চালিয়ে যেতে সহায়তা করার জন্য এই ভূখণ্ডের জনগণের ওপর নৃশংস যুদ্ধাপরাধ চালিয়েছিল, যা বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম একটি। কারণ ১৯৭১ সালের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেছেন রাষ্ট্রপতি
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরপরই, যখন বাংলাদেশ যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে, তখন কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর নেতা মঈন উদ্দিন বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যুক্তরাজ্যে চলে আসেন।
পলাতক হওয়া সত্ত্বেও, তিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পেতে সক্ষম হন এবং ইস্ট লন্ডন মসজিদ এবং লন্ডন মুসলিম সেন্টারের ভাইস-চেয়ারম্যান এবং যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে মুসলিম আধ্যাত্মিক তদারককারী পরিচালক হন।
ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য সান অনুসারে, তিনি এখন উত্তর লন্ডনের সাউথগেটে এক মিলিয়ন পাউন্ডের বাড়িতে থাকেন।
তার অপরাধের চার দশক পর, বাংলাদেশের একটি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্তত ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক এবং চিকিৎসককে হত্যার জন্য মঈন উদ্দিন এবং তার সহযোগী আশরাফুজ্জামান খানের অনুপস্থিতিতে বিচার করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ ২০১৩ সালের নভেম্বরে যুদ্ধাপরাধের জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও ঢাবির সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক এবং ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, ‘এটা স্পষ্ট যে এই ধরনের দ্বৈতনীতির পিছনে একটি নির্দিষ্ট স্বার্থ রয়েছে। যুক্তরাজ্যের স্বার্থের বাইরে কিছুই নয়। মঈন উদ্দিনকে আশ্রয় দেয়ার এই নীতিটি দেখায় যে কীভাবে সেই স্বার্থ মানবাধিকারের ওপর জয়লাভ করে। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, যুক্তরাজ্যের দ্বৈতনীতি আরও বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান বলেছেন, মানবাধিকার নিয়ে যতই বিড়ম্বনা থাকুক না কেন পররাষ্ট্র নীতির ফ্রন্টে যুক্তরাজ্য সবসময় তার নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়।
অধ্যাপক হাফিজুর আরও বলেন, ‘একজন যুদ্ধাপরাধীকে নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের অবস্থান মঈন উদ্দিনের মতো যুদ্ধাপরাধীর হাতে তাদের প্রিয়জন হারিয়ে লাখ লাখ ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা প্রদর্শন করে।’
আরও পড়ুন: যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক সহায়তা ২০২৭ সাল পর্যন্ত স্থগিত হতে পারে: প্রতিবেদন