রবিবার ওই পেপারবুক সরকারি ছাপাখানা (বিজি প্রেস) থেকে প্রস্তুত করে হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান পেপারবুক হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পৌঁছানোর তথ্য গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার পেপারবুক প্রস্তুত হওয়ার ফলে মামলাটির ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানির পথ খুলল। পেপারবুক প্রস্তুত হওয়ায় মামলাটি শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেবেন।
একটি মামলার যাবতীয় নথি (নিম্ন আদালতের রায়, সাক্ষীদের সাক্ষ্য, জেরা, আসামির জবানবন্দিসহ সকল নথি) একসাথে যুক্ত করে বাঁধাই করা নথিকেই পেপারবুক বলে। এই পেপারবুক প্রস্তুত না হলে হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয় না।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ২৪ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পৃথক দুটি অভিযোগপত্র দাখিল হয়। একটি হত্যা এবং অপরটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে। এরপর বিচার শেষে পৃথকভাবে দুটি মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ও সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর দেয়া এই রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা অনুমোদনের জন্য দুটি মামলায় ৩৭ হাজার ৩৮৫ পৃষ্ঠার এই রায়ের কপি (ডেথ রেফারেন্স) ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ছিল হত্যা মামলায় ৩৬৪ পৃষ্ঠা ও বিস্ফোরক দ্রব্য মামলায় ৩০৭ পৃষ্ঠার মূল রায়। এরপর কারাবন্দী আসামিরা ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এ অবস্থায় পেপারবুক প্রস্তুত করতে বিজি প্রেসে পাঠায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের দুই মামলার রায় একই সাথে ঘোষণা করা হয়। হত্যা মামলায় ১৯ জনকে ফাঁসির দণ্ড, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। আর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় ১৯ জনকে ফাঁসি এবং ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। এই ৩৮ জনকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের অন্য ধারায় ২০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। দুই মামলায় আলাদাভাবে সাজা দেয়া হলেও তা একযোগে কার্যকর হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
রায়ে বাবর, পিন্টুসহ ছাড়াও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন- ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, হুজিবি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন (আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই), হুজির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মিরভিত্তিক জঙ্গি নেতা ইউসুফ ভাট ওরফে আবদুল মাজেদ ভাট (পাকিস্তানি), কাশ্মিরভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার নেতা আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, হুজি নেতা মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি (মুফতি হান্নানের ভাই), মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের (তাজউদ্দিনের ভায়রা), হুসাইন আহম্মেদ তামিম, মইনুদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন। হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের উভয় মামলায়ই এই ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে প্রত্যেক মামলায় এক লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে।
তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, কায়কোবাদ ছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন হুজি নেতা শাহাদত্ উল্লাহ জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর হুমায়রা ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমেদ ওরফে হান্নান সাব্বির, আরিফ হাসান সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবু বকর ওরফে হাফেজ ওরফে সেলিম হাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ (ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৩ নম্বর ওয়াডের্র সাবেক কমিশনার), মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুসালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল, মো. লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই ও বাবু ওরফে রাতুল বাবু ওরফে রাতুল (পিন্টুর ভাই)।
দুই মামলায়ই এই ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। উভয় দণ্ড একসাথে চলবে বলে আদেশ দেয়ায় প্রত্যেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
হত্যা মামলায় পুলিশের সাবেক দুই আইজি মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হককে দুই বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অপরাধীকে আশ্রয় দেয়ায় দণ্ডবিধির ২১২ ধারায় দুই বছর করে এবং কোনো অপরাধীকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করায় দণ্ডবিধির ২১৭ ধারায় আবার দুই বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তবে উভয় শাস্তি একইসাথে চলবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে।
অপরাধীকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক (খালেদা জিয়ার ভাগ্নে), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার ও মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিনকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। মাওলানা তাজউদ্দিনকে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করায় তাদের প্রত্যেককে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। উভয় ধারায় প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে। জরিমানার টাকা পরিশোধ না করা হলে আরো ছয় মাস করে কারাভোগ করতে হবে প্রত্যেককে।
পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, তৎকালীন পুলিশ সুপার মো. ওবায়দুর রহমান খানকেও অপরাধীকে আশ্রয় দেয়ার দায়ে দুই বছর এবং অপরাধীকে রক্ষার ব্যবস্থা করায় দুই বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। এই দুজনকে আরও দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে মামলার আলামত নষ্ট করার দায়ে।
মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা ও তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক আইজিপি খোদাবক্স চৌধুরী, সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে দণ্ডবিধির ২১৮ ধারায় (অপরাধীকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর অপরাধ) দুই বছরের কারাদণ্ড এবং দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় (কারো মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করতে বাধ্য করা) তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। একইসাথে জরিমানা করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা করে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে মো. হানিফ, মাওলানা তাজউদ্দিন পলাতক। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে পলাতক আছেন তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, রাতুল বাবু, মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন, মো. খলিল, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল, মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আবদুল হাই।
এছাড়া সাবেক সেনা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, এ টি এম আমিন, সাবেক ডিআইজি খান হাসান সাঈদ, সাবেক এসপি মো. ওবায়দুর রহমান পলাতক।