বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মনে হলেও বাস্তবেই ক্যান্সার খুঁজতে দেহের ভিতর সাঁতার কাটবে ক্ষুদ্র রোবট। বর্তমানে ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্পূর্ণরূপে সার্জারি, রেডিয়েশন এবং কেমোথেরাপির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু একটি টিউমার ধ্বংস করার সময় কেমোথেরাপিগুলো অনিবার্যভাবে ভালো কোষগুলোতেও আঘাত করে। ফলে নিশ্চিতভাবেই রোগীকে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর শিকার হওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হয়।
কিন্তু ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এই রোবট প্রযুক্তি হতে যাচ্ছে এই সব জটিলতার অবধারিত প্রশ্নের একমাত্র উত্তর। সেদিক থেকে এই ধারণাটি দেহের ভেতর অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি না করে সঠিক জায়গায় ওষুধ পৌঁছাতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। চলুন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই অসাধারণ বিকাশ নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
কিভাবে কাজ করবে এই ক্ষুদ্র রোবট
হামাগুড়ি, ডিগবাজি এবং ভেসে থাকা বা সাঁতার কাটতে পারা এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রোবটের আসল উদ্দেশ্য দেহের সংকীর্ণ স্থানগুলোর স্বাভাবিক কাজগুলো তদন্ত করে সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা। বিভিন্ন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন আকৃতি দিয়েছেন এই রোবটগুলোকে। কোনটি মাছ, কোনটি কাঁকড়া, প্রজাপতি; আবার কোন কোন বিজ্ঞানী দল ক্রমাগত আকার বদলাতে পারা রোবট তৈরি করেছেন।
পড়ুন: তীব্র গরমে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে করণীয়
গবেষণায় এগুলো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ক্যান্সার কোষে পৌঁছার জন্য সফলভাবে রক্তনালীর মধ্য দিয়ে চলতে পেরেছে। সাধারণত যে কোন টিউমারের জন্য অম্লীয় পরিবেশ দায়ী, আর এই অম্লত্ব বোঝার পরিমাপক হচ্ছে পিএইচ (পটেনশিয়াল অফ হাইড্রোজেন)। মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর শরীরের ভেতরটা বিভিন্ন দ্রবণের পরিপূর্ণ।
ক্ষুদ্র রোবটগুলো নিজেদের আকার পরিবর্তন করার মাধ্যমে যে কোন দ্রবণের পিএইচ কমাতে পারে। কোন দ্রবণে বিচরণের সময় সেখানকার পিএইচ কমানোর সাথে সাথে এগুলো সঙ্গে করে বয়ে চলা ক্যান্সার প্রতিরোধী ওষুধ ছেড়ে দেয়। ফলে কাছাকাছি থাকা ক্যান্সার কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।
ক্যান্সার নিরাময়ে ক্ষুদ্র রোবটের সাম্প্রতিক অগ্রগতি
আকৃতি পরিবর্তনকারি ক্ষুদ্র রোবটগুলো নিয়ে কাজ করেছিলেন জিয়াওয়েন লি, লি ঝাং, ডং উ ও তাদের সহকর্মী সহ চাইনীজ এক বিজ্ঞানী। তাদের আকৃতি বদল করতে পারা ক্ষুদ্র রোবটগুলো টার্গেটকৃত স্থানে ওষুধ সরবরাহ করতে চৌম্বক শক্তি ব্যবহার করে। আর এ শক্তি যোগান দেয়ার জন্য সেগুলোকে রাখা হয় আয়রন অক্সাইড দ্রবণে। পূর্বে এই রোবটগুলো বেশিরভাগ সময়ই ওষুধ ছেড়ে দেওয়া বা দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করার সময় আকৃতি বদলাতে পারতো না। কিন্তু এখন এই সব জটিলতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে, এগুলো মানুষের রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করানো যেতে পারে এবং চুম্বকের মাধ্যমে টিউমারের দিকে আক্রমণ করা যেতে পারে।
পড়ুন: জাপানে ছোট দোকানগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে বুদ্ধিমান রোবট
একই রকম আকৃতি বদলাতে পারা রোবটে সফল হয়েছিলেন আমেরিকার স্ট্যানফোর্ডের বিজ্ঞানীরাও। এদের রোবটগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে-এগুলো লক্ষ্যে না পৌছানো পর্যন্ত ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রাখে। টার্গেটের কাছাকাছি পৌঁছে এরা উচ্চ-ঘনত্বের ওষুধ ছেড়ে দেয়। অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতি এগুলোকে এই উদ্দেশ্য হাসিলে আলাদা সুবিধা দেয়।
রোবটগুলোর আরো একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এদের কেন্দ্রে রয়েছে একটি দীর্ঘ গর্ত এবং পার্শ্বগুলো কোণাকৃতির। এতে করে এরা সম্মুখ দিক থেকে তরল পদার্থের ধাক্কা উপেক্ষা করে দ্রুত গতি সাঁতরে চলতে পারে।
পড়ুন: উচ্চ রক্তচাপ (হাই প্রেশার) হলে যা এড়িয়ে চলা উচিত: ক্ষতিকর খাবার, পানীয়, অভ্যাস
আমেরিকার বায়োনট ল্যাবসের বিজ্ঞানীরাও তৈরি করেছেন ক্ষুদ্র রোবট যেটি রক্তের প্রবাহের মধ্য দিয়ে সাঁতার কেটে মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে এবং মস্তিষ্কের টিউমারগুলোতে ওষুধ সরবরাহ করতে পারে। সম্প্রতি বায়োনট ল্যাবস ক্যান্ডেল থেরাপিউটিকসের সাথে যৌথ উদ্যোগে ব্রেন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অভিনব ওষুধ সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছে।
তাদের পরিকল্পনা হল ক্যান্ডেলের ওষুধ এবং বায়োনাটের দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত ক্ষুদ্র রোবটকে একত্রিত করা, যাতে কার্যকরভাবে মস্তিষ্কের টিউমারগুলোকে লক্ষ্য করা যায়। রোবটগুলো বায়োনটস নামে পরিচিত এবং এগুলো চুম্বক শক্তির মাধ্যমে সরাসরি মস্তিষ্কের টিউমার লক্ষ্যে যাত্রা করতে পারে।
স্পেনের বার্সেলোনার ক্যাটালোনিয়ার ইনস্টিটিউট ফর বায়োইঞ্জিনিয়ারিং-এর রসায়নবিদ স্যামুয়েল সানচেজ মূত্রাশয় ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য তৈরি করছেন অতি ক্ষুদ্রকায় রোবট। এগুলোতে থাকা ন্যানোমোটরগুলো মৌচাকের ন্যায় ছিদ্রযুক্ত সিলিকা ন্যানো পার্টিকেল, ক্ষুদ্র সোনার কণা এবং ইউরিস এনজাইম দ্বারা গঠিত। ৩০০ থেকে ৪০০ ন্যানোমিটার এই রোবটগুলো মূত্রাশয়ের রাসায়নিক ভাঙ্গনের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অ্যামোনিয়াতে পরিণত হয়।
পড়ুন: অ্যান্ড্রয়েড-১৪ ফোনে সরাসরি স্যাটেলাইট সংযোগ: যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন অধ্যায়
ক্যান্সার নিরাময়ে দেহের ভিতর সাঁতরে চলা রোবট প্রযুক্তির অনুপ্রেরণা
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই পুরো ধারণাটি অনেকাংশে মিলে গেছে ১৯৬৬ সালের ফিল্ম ফ্যান্টাস্টিক ভয়েজ-এর সাথে। এখানে একটি ক্ষুদ্র সাবমেরিন একদল গবেষককে নিয়ে একজন বিজ্ঞানীর মস্তিষ্কে রক্তের জমাট বাঁধা অপসারণের অভিযানে যায়। এখানে দেখানো হয়, সাবমেরিনের সাথে সাথে তার আরোহীরাও সঙ্কুচিত হয়ে একদম ক্ষুদ্রাকৃতি হয়ে গিয়েছিল।
অতঃপর তারা রক্তনালীর রক্তপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যাত্রা করে চূড়ান্ত ভাবে সেই বিজ্ঞানীর ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কল্পকাহিনী একদম হুবহু অনুকরণ করা সম্ভব না হলেও রক্তশিরায় ক্ষুদ্র রোবটের সাঁতরে চলা বিরাট এক পদক্ষেপ। দূর থেকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য মাছের আকৃতির ওষুধ সরবরাহকারি রোবট আরোহীসহ সঙ্কুচিত সাবমেরিনের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়।
অন্যদিকে, স্ট্যানফোর্ড বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনের অনুপ্রেরণা ছিল জাপানের অরিগ্যামি শিল্প, যেখানে কাগজ ভাজ করে বিভিন্ন আকৃতির অবয়ব তৈরি করা হয়। কিন্তু এই প্রভাবটি শুধুমাত্র কাঠামোগত দিক থেকেই ছিল। কাজের দিক থেকে এই রোবটগুলো শরীরের অভ্যন্তরে যে কোন পরিবেশে নিজেদেরকে অপরিবর্তিত রেখে ভেসে যেতে পারে।
পড়ুন: এয়ার কন্ডিশনার ছাড়াই গরমে ঘর ঠান্ডা রাখার কার্যকরী উপায়
চিকিৎসা বিজ্ঞানে অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন
স্ট্যানফোর্ডের রোবটগুলো শুধুমাত্র কার্যকরভাবে ওষুধ সরবরাহই করবে না, পাশাপাশি শরীরের ভেতরে ক্যামেরাও বহন করতে পারবে। এতে ডাক্তাররা রোগীদের রিয়েল-টাইম পরীক্ষা করতে পারবেন। দলটি আল্ট্রাসাউন্ড ইমেজিং ব্যবহার করে রোবটগুলোর বিচরণ ট্র্যাক করার জন্যও কাজ করছে। এটি সফলভাবে প্রয়োগ সম্ভব হলে অঙ্গ কাটার বিড়ম্বনা দূর হবে।
স্প্যানীশ রসায়নবিদ সানচেজের মূত্রাশয় ক্যান্সার বিধ্বংসী রোবটগুলোকে একদম শিরাপথে প্রবেশ করানোর পরিকল্পনা চলছে। এতে করে ক্যান্সারের কোষটির দিকে থেরাপিউটিক এজেন্টের কার্গোকে সঠিক ভাবে পরিচালনা করা যাবে। এর কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহারের প্রচেষ্টা চলছে। সর্বসাকূল্যে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে নেতৃত্ব দেয়া গেলে অ্যান্টিবডি টিউমার চিহ্নিত করে তা ধ্বংস করতে পারবে। এটি যদি সম্ভব হয়, তাহলে সম্ভাব্য সব রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়ানো যাবে।
পরিশিষ্ট
স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও অস্ত্রোপচারে রোবটের ব্যবহারিক প্রয়োগের গবেষণা চিকিৎসার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় অবদান রাখছে। অস্ত্রপোচারে ক্ষুদ্র জায়গায় যতটা সুক্ষভাবে কাজ করা যায় তা ততটাই সুফল দেয়। এই বিষয়টি নিশ্চিত করতেই ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হবে আধুনিক মাইক্রোবট (ক্ষুদ্র রোবট) প্রযুক্তি। তবে মূলধারার চিকিৎসায় এই প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে উপলব্ধ হতে এখনো দীর্ঘ পথ বাকি। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই ক্রমবর্ধমান জোয়ার ক্ষুদ্র রোবটের মাধ্যমে বিপুল পরিসরে কার্যকরী স্বাস্থ্যসেবার অগ্রদূত হয়ে থাকবে।
পড়ুন: টেক্সট নেক সিন্ড্রোম: অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলাফল