গীতিকার ও জ্যোতির্বিদ হিসাবে সারা দেশ জুড়ে খ্যাতি পেলেও কাওসার আহমেদ চৌধুরী নামের মানুষটির নিভৃত বিচরণ ছিলো আধুনিক বাংলা সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে। শত গুণের অধিকারি এই জীবন যোদ্ধা হাজারো প্রাপ্তির সীমানা ছাড়িয়ে গত ২২ ফেব্রুয়ারি পাড়ি জমালেন পরপারে। ঢাকার একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় রাত ৯টা ৪০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। জীবদ্দশায় নির্দিষ্ট কোন একটি শাখায় কখনো তিনি নিজেকে আবদ্ধ রাখতেন না। সব সময় চেষ্টা করে যেতেন নতুন কিছুতে নিজের সাক্ষর রাখার। এই নিভৃতচারী বিনোদনকর্মীকে নিয়েই আজকের ফিচার।

নানা পরিচয়ে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর পরিচিতি

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। শিক্ষাজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পড়াশোনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তাঁর গান লেখার হাতেখড়ি।

পড়াশোনার পাঠ না চুকিয়ে অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই যোগ দেন সরকারি চাকরিতে। কবিতা লেখার দক্ষতা তাঁর ছোটবেলা থেকেই ছিলো। তাঁর প্রকাশিত একমাত্র কবিতার বইয়ের নাম ‘ঘুম কিনে খাই’। শুধু কবিতা আর গানই নয়; তিনি একাধারে বিচরণ করেছেন চিত্রনাট্য রচনা, ছবি আঁকা এবং চলচ্চিত্র পরিচালনাতে।

আরও পড়ুন: বাপ্পি লাহিড়ী: বলিউড সাম্রাজ্যে ডিস্কো সঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ

তিনি বেশ কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন। সেগুলোর মধ্যে স্বনামধন্য কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কবিতার বই ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ এর প্রচ্ছদ অন্যতম।

সরকারি প্রজেক্ট পরিবার পরিকল্পনার ওপর বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই তাঁর নির্মিত বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র আছে। বিজ্ঞাপন নির্মাণের কাজও করেছেন তিনি। তাঁর রচিত চিত্রনাট্যের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা বিটিভিতে প্রচারিত কমেডি নাটক ‘ত্রিরত্ন’।

কাওসার আহমেদ চৌধুরীর আরেকটি বড় পরিচয় হচ্ছে- তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের অধীনে তিনি গুপ্তচর হয়ে হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতেন। ছবি আঁকার হাত ছিলো বিধায় পাকিস্তানি বাহিনীর আস্তানার পথের নকশা এঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের রুদ্ধঃশ্বাস অভিযানগুলোতে সাহায্য করতেন তিনি।

আরও পড়ুন: আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত কাওসার আহমেদ চৌধুরী

কাওসার আহমেদ চৌধুরী রচিত সাড়া জাগানো গানগুলো

কাওসার আহমেদ-এর গান লেখা শুরু হয় তাঁর বোনের অনুপ্রেরণায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়ার সময়, বোনের বাসায় থেকেই পড়াশোনা করতেন তিনি। তাদের বাসা ছিলো আজিমপুর কলনীতে। সেখানে প্রতিবেশী হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী খন্দকার ফারুক আহমেদকে। এই ফারুক আহমেদ-ই কবি কাওসার আহমেদকে গান রচনায় আসতে সহায়তা করেন।

তাঁর লেখা প্রথম গান সম্প্রচার হয়েছিলো সিলেট বেতারে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে। স্বাধীনতার অনেক পরে ৯০-এর দশকে গীতিকার হিসেবে দেশ জুড়ে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি লিখেছেন কুমার বিশ্বজিতের সঙ্গীত জীবনের সেরা গান ‘যেখানেই সীমান্ত তোমার’, বর্ষিয়ান শিল্পী নিয়াজ মোহাম্মদের ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’, প্রয়াত সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী লাকী আখন্দের 'আমায় ডেকো না', সামিনা চৌধুরীর গাওয়া ‘কবিতা পড়ার প্রহর’। এমনকি ব্যান্ড সঙ্গীতের গানও রচিত হয়েছে তাঁর লেখনিতে। ফিডব্যাকের ‘মৌসুমি’ গানের দুটি পার্ট-ই তাঁর লেখা। প্রয়াত ব্যান্ড সঙ্গীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর জনপ্রিয় গান 'এই রুপালি গিটার ফেলে’ গানের কথা দিয়েছেন তিনি। এছাড়া বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে প্রচারিত শিল্পী নাফিস কামালের গাওয়া ‘এই শহরে এক নগর ছিল’ গানটির কথাও লিখেছেন কাওসার আহমেদ।

আরও পড়ুন: মাইকেল শিরোনামে নির্মিত হবে ‘কিং অফ পপ’ মাইকেল জ্যাকসনের বায়োপিক

জ্যোতির্বিদ হিসেবে কাওসার আহমেদ চৌধুরী

মাত্র ১১ বছর বয়সে জ্যোতির্বিদ্যা অনুশীলনে নিয়োজিত হন কাওসার আহমেদ। পরবর্তীতে হাজারো কাজের মাঝে এই বিদ্যাটা যেন তিনি তাঁর অন্তরে অতি যত্নে পোষণ করে আসছিলেন। তারই ফলস্বরূপ দেশ জুড়ে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘আপনার রাশি’ শিরোনামের তাঁর রাশিফল গণনাটি। ভক্তদের কাছে গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরী পরিণত হন একজন জ্যোতির্বিদে। তিনি নিজেও জ্যোতিষী পরিচয়টা বয়ে বেড়াতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।

শেষাংশ

বিনোদন জগতের বিভিন্ন বিভাগের স্বনামধন্য ব্যক্তিদের খুবই কাছের মানুষ ছিলেন গীতিকার ও জ্যোতির্বিদ কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তাঁর চলাফেরা ছিলো ভারতের চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, সঙ্গীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম, বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক শেখ সাদী খান, সঙ্গীত শিল্পী মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী লাকী আখন্দের মত কিংবদন্তিদের সঙ্গে। ২৩ ফেব্রুয়ারি বুধবার তাকে সসম্মানে সমাধিস্থ করা হয় ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে।

আরও পড়ুন: সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর: ভারতীয় সংগীতের জগতে অবিস্মরণীয় উজ্জ্বল নক্ষত্র