২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার থেকে বর্তমানে ১৩ বিলিয়ন ডলারের কম হতে পারে। এমন প্রকৃত পরিমাণে নেমে আসা দেখে বাংলাদেশ ব্যাংক এ লেভেলের সামষ্টিক অর্থনীতির একজন ছাত্রের মতো দেশের রিজার্ভের পরিমাণ নির্ধারণে বিভিন্ন ধরণের গণনা এবং সংজ্ঞা ও তাদের বিভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে জানার চেষ্টা শুরু করেছে।
দেশের রিজার্ভকে ঘিরে যে জটিল আলোচনা তৈরি হয়েছে- এই প্রক্রিয়া, সূত্র, আইএমএফের নির্দেশিকা এবং রিজার্ভ থেকে ঋণ আকারে পরিশোধ- যা প্রাথমিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। এর সবই কিছু সময়ের জন্য পুরো পরিস্থিতিকে অন্ধকারে রেখেছে। ভোক্তারা বিভিন্ন ধরণের তথ্যের কারণে লড়াই করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে কিছু অনৈতিক ব্যবসায়ী নির্বিচারে দাম বাড়িয়ে লাভবান হচ্ছেন।
ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট 'ডলার সংকটের' অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদক এমন অভিমত পেয়েছেন।
ভোলার চরফ্যাশনের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলম (৫০) গত ১৭ বছর ধরে ঢাকার মগবাজার এলাকায় ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন। তিনি স্ব-কর্মসংস্থানেই কাজ করেন। যদি কারও বৈদ্যুতিক লাইন বসাতে হয়, একটি ফ্যান লাগানো ইত্যাদির প্রয়োজনে ডাক পেলে তিনি কাজ করেন।
ঈদুল ফিতরের পর থেকে গত এক মাস ধরে বাসায় গিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে যেকোনো কাজের জন্য ন্যূনতম ৫০০ টাকা নিচ্ছেন আলম। চলতি বছরের ঈদ পর্যন্ত এবং দীর্ঘদিন ধরে এই সেবার জন্য ৩০০ টাকা পরিষেবা বিল নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করলেন দেবপ্রিয়
আলম বলেন, ‘ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে খাবার, ওষুধ, ইউটিলিটির খরচ বেড়ে যাওয়ায় ৫০০ টাকার নিচে কেউ দিলে আমরা সেবা দিতে পারছি না। আমাদের সার্ভিস বিল কেন বাড়তে পারে না।’
আলম নিজেই ইউএনবির প্রতিবেদকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মজুদ নিয়ে সত্যিই ভয়াবহ জটিল অবস্থা চলছে কিনা, কারণ ‘প্রায় সব দোকানদারই যে কোনো পণ্যের জন্য বেশি দাম নেওয়া শুরু করেছেন।’
শফিউল আলম দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তারা বরাবরই উত্তর দেন, 'বাংলাদেশে ডলার সংকটের কারণে দাম বেড়েছে।
জামালপুর মেলাদহ উপজেলার একাব্বর আলী গত ২৫ বছর ধরে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় রিকশা চালান। ঈদুল ফিতর পর্যন্ত আগে যে দূরত্ব ২০-২৫ টাকা নিতেন, এখন সেই দূরত্বের জন্য সর্বনিম্ন ৩০-৪০ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন তিনি।
আলী জানান, যে গ্যারেজ থেকে তিনি রিকশা ভাড়া নেন। গ্যারেজ মালিক সেই রিকশার ভাড়া চালকদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি 'ডলার সংকটের' দাবি করে সবকিছুই বেড়েছে।
আরও পড়ুন: ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এডিপির সর্বোচ্চ ৩৮৮০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ পাচ্ছে এলজিডি
আলী জোর দিয়ে বলেন, ডলার সংকটের কারণে খাদ্য, ওষুধসহ সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রায় সব পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যায়। রিকশার ভাড়া না বাড়ালে আমরা বাঁচতে পারব না।’
বড় মগবাজার রেলগেট এলাকার মুদি ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান জানান, তার সরবরাহকারীরা সপ্তাহে কয়েকবার দাম বাড়াচ্ছেন, আবার ডলারের দাম বেশি দাবি করছেন। তাই তাদের (ব্যবসায়ীদের) বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের তিনটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। যা তিনটি পদ্ধতিতে গণনা করা হয়।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকুর) কাছে মার্চ ও এপ্রিলের আর্থিক দায় মেটানোর পর বাংলাদেশ ব্যাংকের 'মোট রিজার্ভ' (১৪ মে) কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলারে। মোট রিজার্ভটি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি গণনা পদ্ধতির। এর মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে (ইডিএফ) ব্যয়িত রিজার্ভের অর্থও অন্তর্ভুক্ত।
আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুযায়ী মোট রিজার্ভের পরিমাণ ১৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের সামান্য কম। প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ গণনায় বিভিন্ন ঋণের আর্থিক দায় বাদ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা বোঝার জন্য আইএমএফ এই পদ্ধতিও অনুসরণ করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মতে, ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম, যা গণমাধ্যমে প্রকৃত রিজার্ভ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রিজার্ভের এই হিসাবটি রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণের জন্য পরিশোধিত অর্থের পাশাপাশি আইএমএফের এসডিআর হিসাবে রাখা ডলার বাদ দেয়।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কখনোই প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে না।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের ওয়াশিংটন অফিসের সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর ইউএনবিকে বলেন, মোট রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থাৎ রিজার্ভ এখনো ঝুঁকিতে নেই।
কিন্তু মুদ্রাবাজার ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আস্থার অভাব রয়েছে এবং বাংলাদেশের রিজার্ভ অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।
ড. মনসুর বলেন, অনিয়ন্ত্রিত মানি লন্ডারিং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উদ্বেগের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যা রিজার্ভ এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাসের সঙ্গে দুটি প্রধান ঝুঁকি জড়িত। একটি হলো ডলার পেমেন্ট করতে অক্ষমতা, যা সাধারণত আমদানি করা পণ্যগুলোর জন্য প্রয়োজন হয়। আমদানি কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়তে পারে।
আরও পড়ুন: রিজার্ভের পরিসংখ্যানের ভিন্নতা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারকে অস্থিতিশীল করছে