সন্তানের কাজ জুটলে মুখে খাবার ওঠে, না হলে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটে। অভাবের তাড়নায় অন্য ছেলেরা আলাদা করে দিয়েছেন আশি-ঊর্ধ্ব বিধবা বৃদ্ধা শান্তি রাণীকে।
আরও পড়ুন: ‘রোগ’ নেই, তবু হাসপাতালই ঠিকানা বৃদ্ধা পারভীনের!
স্বামী সুধীর চন্দ্র সরকার অসুস্থতাজনিত কারণে প্রায় ৩০ বছর আগে মারা গেছেন। নিজের থাকার ঘরের একদিকে বিছানা অন্যদিকে খড় বিছানো গরুর থাকার জায়গা। এভাবেই তার দিন যাচ্ছে। শান্তি রাণীর তিন ছেলে, চার মেয়ে। ছোট ছেলে বাদে সবারই বিয়ে হয়ে গেছে।
জমিজমা বলতে বাড়ি ভিটে তিন শতক। অর্ধেক অংশে বড় ছেলে প্রবিত্র চন্দ্র সরকার তার পরিবার নিয়ে আর বাকি অংশে থাকেন শান্তি রাণী। তার ঘরের সাথে স্তুপ করা অন্য ঘরে থাকেন ছোট ছেলে অমৃত চন্দ্র সরকার। বয়স থাকতে শান্তি রাণী মানুষের বাসায় কিংবা কৃষি কাজ করলেও এখন বয়সের ভারে খাটতে পারেন না।
আরও পড়ুন: স্বজনদের অপেক্ষায় হাসপাতালে বৃদ্ধার অপেক্ষা!
তাই সন্তান কিংবা প্রতিবেশিদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। মানুষের কাছ থেকে একটি গরু আদী (গরুর বিনিময়ে গরু পাওয়ার শর্তে) নিয়ে সেই গরু লালন পালন করেন। সেই আদীকৃত গরু থেকেই তিনি একটি গরু পেয়েছেন। জরাজীর্ণ ঘরে জায়গা না থাকার কারণে গরুর গোয়াল তৈরি করতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে নিজ ঘরেই গরুসহ দিন পার করছেন শান্তি রাণী।
কাঠমিস্ত্রি ছেলের ভাগ্যে কাজ জুটলে মা-ছেলের দু’জনের পেটে ভাত পড়ে নতুবা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন অতিবাহিত করতে হয়। দিন এনে দিন খাওয়া প্রতিবেশিরাও তাদের সামর্থের মধ্যে সহযোগিতা করলেও সবসময় সেটাও সম্ভব হয়ে ওঠে না।
আরও পড়ুন: নাটোরের বড়াইগ্রামে আগুনে পুড়ে বৃদ্ধার মৃত্যু
কান্না জড়িত কন্ঠে বৃদ্ধা শান্তি রাণী বলেন, ‘ছেলে দিনমজুরি খাটে। দিনে যা আনে খাই না আনলে না খাই। কাইও (কেউ) যদি একমুট দেয় তাইলে খাই আর না দিলে অমনে (না খেয়ে) থাকি। একটা গরু আদী নিছনু (নিছিলাম) সেটা থাকি বাছুর হইছে। গাই কোনা (গাভীটা) ঘোরত (ফেরত) দিছং (দিছি)। আর বাছুরটাকে এমন করি বড় করবাইছি (পালন করছেন)। বেটিগুলার (মেয়ে) বিয়ে দেবার সময় সম্পদ য্যাকনা (যা) ছিল সব শেষ হইছে। আর বাকি দুই বেটা (ছেলে) বিয়া করি বউ ছোয়া (ছেলে) নিয়া জুদা (আলাদা) খায়। হামরা মা-ছোট বেটা মিলে খায়া না খায়া দিন কাটাই।’ সরকারি ভাতা বলতে দু’বছর আগে শুধু বয়স্ক কার্ড পেয়েছেন। এছাড়া আর কোনো সরকারি সহযোগিতা পান না বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: মোহনগঞ্জে গরুকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে বৃদ্ধার মৃত্যু
শান্তি রাণীর বড় ছেলে প্রবিত্র চন্দ্র সরকার জানান, কাঠমিস্ত্রির কাজ করে নিজের পরিবার নিয়ে চলা দায়। তাই এমনিতেই মায়ের খোঁজ রাখলেও ভরণ-পোষণ নিতে না পেরে ছোট ভাইয়ের সাথে মাকে আলাদা করে দিয়েছেন।
প্রতিবেশি স্বপ্না রাণী জানান, প্রায় বিশ বছর ধরে এমন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বিধবা শান্তি রাণী। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তেমনটি খোঁজ খবর রাখেন না। ভাঙা ঘর থাকলেও নেই কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থা। খোলা জায়গা বা প্রতিবেশিদের বাড়িতে গিয়ে সারেন প্রাকৃতিক কাজ।
আরও পড়ুন: পাবনায় ট্রেনের ধাক্কায় বৃদ্ধার মৃত্যু
প্রতিবেশি গীতা রাণী জানান, বৃষ্টি আসলে শান্তি রাণীর কষ্ট আরো দ্বিগুণ হয়ে যায়। বাইরে রান্নার চুলা ভিজে যায়। রান্না করতে পারে না। বেশির ভাগ সময়ই না খেয়ে দিন পার করেন ছেলে-মা। বছর খানেক আগে আঙ্গিনায় পিছলে পড়ে শান্তি রাণীর হাত ভেঙ্গে যায়। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেনি। গ্রাম্য চিকিৎসা খড়ি দিয়ে ভাঙা জায়গা বেঁধে রাখেন। বিছানাতেই প্রসাব পায়খানা করেছে। মায়ের জন্য ছোট ছেলে অমৃত চন্দ্র সরকার বিয়ে করেনি।
রাজারহাট চাকিরপশার ইউপি ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার সন্তোষ চন্দ্র মোহন্ত জানান, সরকারি বিধি মোতাবেক একই পরিবারকে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেবার নিয়ম নেই। এরপরও বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে কথা বলে সহযোগিতার আশ্বস দেন তিনি।