খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেকারত্বের হতাশায় ভোগা যুবকেরা হাঁস পালনকারী খামারিদের কাছে পরামর্শ নিয়ে ২০ থেকে ২৫ টাকায় প্রতিটি হাঁসের বাচ্চা কিনে এনে ৩ থেকে সাড়ে তিন মাস লালন-পালন করে বিক্রি করছেন। এতে খামারের প্রতিটি হাঁসের পেছনে খরচ পড়ছে ৯০ থেকে ১১০ টাকা। আর প্রতিটি হাঁস বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। এতে করে হাঁস প্রতি লাভ হচ্ছে ৩০০ টাকার বেশি।
এছাড়া যারা খামারের হাঁস পার্শ্ববর্তী জলাশয় ছেড়ে দিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছেন তাদের খরচ আরও অনেকটা কমে যাচ্ছে বলে জানান অনেক খামারি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আড়াই বছর আগে সামান্য পুঁজি নিয়ে হাঁস লালন-পালন শুরু করেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের সিতাইঝাড় গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সাজেদুল ইসলাম (২৮)। হাঁসের খামার করার লক্ষ্য নিয়ে পুরোপুরি মনোযোগী হন হাঁস লালন-পালনে। আর এতেই বেকারত্ব ঘোচানোর পাশাপাশি ভাগ্য বদল হতে শুরু করে তার। বর্তমানে সাজিদুলের খামারে রয়েছে প্রায় ৪ শতাধিক হাঁস।
এ হাঁসগুলো ডিম পাওয়ার আশায় লালন-পালন করছেন না তিনি। পার্শ্ববর্তী জেলা গাইবান্ধা থেকে প্রতিটি হাঁসের বাচ্চা ২০-২৫ টাকা দরে কিনে এনে তা তিন থেকে সাড়ে ৩ মাস লালন-পালন করেন। এরপর প্রতিটি হাস বিক্রি করেন ৪০০ থেকে সাড়ে ৪৫০ টাকায়। এতে তার এক চালানে হাঁসের খাবার ও ওষুধের খরচ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয় প্রায় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা।
সাজিদুল ইসলাম বলেন, আমি একেবারেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমার বাবা মারা যান। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট আমি। বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের সংসারে থেকে ২০০৯ সালে এসএসসি পাস করার পর অভাবের কারণে আর লেখাপড়া করতে পারিনি। এরপর থেকে সংসারের অভাব মেটাতে বিভিন্ন কাজ ও ছোট-খাটো ব্যবসা করার চেষ্টা করি। কিন্তু কোথাও মন বসাতে পারিনি। সব জায়গাতেই লস হওয়ায় হতাশায় পড়েছিলাম।
তিনি বলেন, ‘এলাকার এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে আড়াই বছর আগে কিছুটা ধার-দেনা করে গাইবান্ধা থেকে হাঁসের বাচ্চা কিনে এনে খামারে মনোযোগ দেই। প্রথম দিকে আমি ১০০ হাঁসের বাচ্চা দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে আমি প্রতি চালানে ৪০০ হাঁসের বাচ্চা নিয়ে এসে সাড়ে ৩ মাস লালন পালন করে বিক্রি করে দেই। এতেই আমার সব খরচ বাদ দিয়ে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। এই আয় দিয়েই আমার পরিবার চলার পরও কিছু জমা থাকে।’
খামারি সাজিদুল বলেন, আমার পরিকল্পনা আছে সামনে আরও বড় পরিসরে হাঁসের খামার গড়ে তোলার। তবে সরকারি সহযোগিতা পেলে হাঁসের বড় খামার করতে সুবিধা হত বলে জানান তিনি।
সাজিদুলের মতই নিজের বেকারত্ব ঘোচাতে হাঁসের খামার গড়ে তুলেছেন একই ইউনিয়নের শুলকুর বাজার এলাকার ছকিমুদ্দিন। তার খামারে বর্তমানে ৪ শতাধিক হাঁস রয়েছে। এর মধ্যে খাকি ক্যাম্বেল জাতের ২০০ হাঁস ডিমের জন্য লালন-পালন করছেন।
ছকিমুদ্দিন বলেন, ‘আমি দুই ভাগে খামারে হাঁস রেখেছি। অর্ধেক ডিমের জন্য আর অর্ধেক বিক্রির জন্য। প্রতিদিন খামারে ২০০ হাঁস থেকে দেড় শতাধিক ডিম আসে। তবে ডিম দেয়া হাঁসকে খাবার একটু বেশি দিতে হয়। বাজারে হাঁসের ডিমের চাহিদা ভালো এজন্য দুটো লাভবান হচ্ছি।’
তবে নতুন খামার করে ক্ষতির মুখে পড়েছেন পাঁচগাছী ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের গ্রামের আশরাফুল আলম। দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর আগে সাড়ে তিন হাজার হাঁস কিনে খামার শুরু করেছেন তিনি। কিন্তু চলতি বন্যায় খামারের সাড়ে ৩ হাজার হাঁসের ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারেননি তিনি। এতে করে কিছু হাঁস মারা গেছে। বাকি হাঁস বিক্রি করে আবারও নতুন হাঁসের বাচ্চা খামারে তুলেছেন বলে জানান আশরাফুল আলম।
অন্যদিকে সদরের বেলগাছা ইউনিয়নের মো. রশিদ আলী প্রায় ৬ বছর ধরে পুকুরের পাশে খামার ঘর করে ২০০ খাকি ক্যাম্বের জাতের হাঁস পালন করছেন। পুকুরে হাঁস পালন করায় খামারিদের চেয়ে খরচ অনেক কম পড়ে এবং লাভ বেশি হয় বলে জানান তিনি।
পাঁচগাছী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, সাজিদুল খুবই পরিশ্রমী ছেলে। সে হাঁসের খামার করে তার বেকারত্ব ঘুচিয়েছে। তার দেখাদেখি এই ইউনিয়নেই আরও খামার গড়ে উঠছে। আমি মনে করি যারা লেখাপড়া করেও বেকারত্বের হতাশায় পড়ে আছে তারা সাজিদুলের কাছে পরামর্শ নিয়ে তার মতো হাঁসের খামার গড়ে তুলতে পারলে আর বেকারত্ব থাকবে না।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল হাই সরকার জানান, জেলার ৯ উপজেলায় ছোট বড় মিলে প্রায় সাড়ে ৪ শতাধিক হাঁসের খামার রয়েছে। হাঁসের খামার লাভজনক ও বিভিন্ন বিল, জলাশয়ে হাঁস লালন-পালনের অনেক সুবিধা থাকায় জেলায় প্রতিবছর হাঁসের খামার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রাণি সম্পদ বিভাগ থেকে এই খামারিদের পরামর্শ দিয়ে থাকি। পাশাপাশি করোনাকালীন সময়ে সরকারি প্রণোদনার জন্য খামারিদের তালিকা পাঠানোর কাজ চলছে। সরকারি প্রণোদনা পেলে তারা আরও লাভবান হতে পারবে।’