তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলা ভাষাভাষী যারা তাদের ওপরেই এই সংরক্ষণ ও গবেষণার দায়িত্ব বর্তায়।’
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বার্তাসংস্থা ইউএনবিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
আরও পড়ুন: মাতৃভাষা দিবসে ‘বাংলা ফন্ট’ চালু করল জাতিসংঘ
অধ্যাপক ড. মো. আশ্রাফুল করিম বলেন, ‘আমরা জানি যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অনেক। এই গোষ্ঠীর বড় একটা অংশ সিলেটের বিভিন্ন চা বাগান, পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ এসব জেলার পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করছে। বৃহত্তর সিলেটের তিন জেলায় (সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ) চা বাগান রয়েছে, আর সবচাইতে বেশি চা বাগান রয়েছে মৌলভীবাজারে। এইসব চা বাগানে অনেক শ্রমিক আছেন যারা আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অবদান রাখছেন। এসব জায়গায় বসবাসরত চা শ্রমিকেরা চা বাগানে নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভঙ্গিতে কথা বলেন। চা শ্রমিকদের দীর্ঘদিন এক অঞ্চলে বসবাসের ফলে তাদের ভাষার সাথে আঞ্চলিক বাংলা ভাষার মিশ্রণে এক নতুন ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়। গবেষণা করতে গিয়ে দেখতে পাই স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছে দেশোয়ালি ভাষা।’
আরও পড়ুন: ভাষাসৈনিক ও সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মারা গেছেন
আরও পড়ুন: ভাষাভিত্তিক আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের দূরদর্শী স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু: মন্ত্রী জব্বার
দেশোয়ালি ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে ড. আশ্রাফুল বলেন, ‘বৃহত্তর সিলেটের চা বাগানগুলোতে কর্মরত চা শ্রমিকেরা ১৫০ বছর পূর্বে ভারতের বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা ও মাদ্রাজের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছে। প্রথম দিকে এরা যার যার অঞ্চলের যার যার জাতির ভাষা ব্যবহার করতো। পরবর্তীতে নিজেদের প্রয়োজনে, স্থানীয়দের সাথে মিশতে গিয়েই এই দেশোয়ালি ভাষায় কথা বলার অভ্যস্ত হয়। এই দেশোয়ালি ভাষায় অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মতো আলাদা লিপি বা বর্ণের ব্যবহার নেই।’
তিনি বলেন, সিলেটে আরেকটি ভাষা রয়েছে পাত্রদের ‘লালং’ ভাষা। এই ভাষার উপরেও আমার গবেষণায় একটি প্রবন্ধ বের হয়েছে। দেশোয়ালি ভাষায় হিন্দি, স্থানীয় বাংলা ও তাদের নিজস্ব ভাষার (যার যার অঞ্চলের) একটি মিশ্রণ পাওয়া যায়। এই ভাষার বর্ণমালা বা লিপি না থাকলেও, মৌখিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন: বাংলাসহ ১০ ভাষায় হজের খুতবা: মক্কার ও মসজিদ নববীর ইমাম
গবেষক ড. আশ্রাফুল বলেন, ‘চা শ্রমিকদের আর্থসামাজিক বিষয়ের উপর বিভিন্ন জরিপ, গবেষণা করা হলেও তাদের ভাষার উপর নজর নেই বললেই চলে। বৃটিশদের দেয়া সম্বোধন হিসেবে স্থানীয়দের কাছে এখনও এই চা শ্রমিকদের কুলি নামে ডাকা হয়। সামাজিকভাবে অবহেলিত হওয়ায় এই শ্রেণির লোকদের ভাষার প্রতি আমাদের নজর নেই।’
তিনি বলেন, গবেষণা করতে গিয়ে দেখতে পাই দীর্ঘদিন থাকার ফলে এই চা শ্রমিকদের দেশোয়ালি ভাষায় বাংলা ভাষার প্রভাব লক্ষণীয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়: ‘হাসো কেনো’ মানে বাংলাকে তারা বলে ‘আছিস ক্যানে’, ‘তাড়াতাড়ি কাজ করো’ এইটিকে তারা বলছে ‘জলদি কাম করবেক’, বাবাকে ‘বাপ্প’, মাকে ‘মাআ’ সৎমাকে ‘সওতমা’, দুলাভাইকে ‘পাহুন’ চাচাকে ‘ককা’, দাদাকে ‘জেজ বপ্পা’ প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়।
আরও পড়ুন: ভাষা সৈনিক দেবপ্রিয় বড়ুয়া আর নেই
আমরা জানি, এই চা শ্রমিকরা নানাভাবে পিছিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ করে লেখাপড়ায়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী চা বাগান এরিয়াতে একমাইলের মধ্যে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নেই। বর্তমানে এই চা শ্রমিকেরা বাংলাদেশেরই নাগরিক। দেশের রপ্তানিমুখী এই চা শিল্পে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্ব বহন করছে এই চা শ্রমিকেরা। চাকমারা তাদের ভাষায় অভিধান রচনা করেছেন যার নাম ‘চাকমা বাংলা অভিধান’, মণিপুরীদের ভাষার উপরেও গবেষণা হচ্ছে, বই রচিত হচ্ছে, সাঁওতালদের রয়েছে ইংরেজি অভিধান। ঠিক এমন করে দেশোয়ালি ভাষারও অভিধান রচনাসহ শব্দ সম্ভার সংগ্রহের জন্য আমরা উদ্যোগ নিতে পারি, বলেন তিনি।
আরও পড়ুন: ভাষা শেখার আগে যেসব বিষয় জানা জরুরি
ড. আশ্রাফুল করিম বলেন, ‘সরকারি কিংবা বেসরকারি যেকোনো সংস্থার উচিৎ এই দেশোয়ালি ভাষায় গবেষণার জন্য এগিয়ে আসা। এছাড়াও এই ভাষা প্রচারের লক্ষ্যে রেডিও, টেলিভিশনে অন্তত প্রতিমাসে একবার হলেও এই ভাষার সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রচার করা উচিৎ। স্থানীয় প্রশাসনসহ পত্র, পত্রিকার এ বিষয়ে এগিয়ে আশা উচিৎ। বিলুপ্ত ভাষা রক্ষা করা বিশ্বের তাবৎ দেশের দায়িত্ব। তবে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে এই বাংলা ভাষী বাংলাদেশের মানুষের দায়িত্ব একটু বেশি।’
আরও পড়ুন: শাবিতে এবার ফরাসি ভাষায় একুশের গান
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সরকার প্রাক-প্রাথমিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের যার যার ভাষায় পাঠদানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করছে। তারই ধারাবাহিকতায় চা উৎপাদন অঞ্চলসমূহে প্রাক-প্রাথমিকে এই ‘দেশোয়ালি’ ভাষায় পাঠদান শুরু করা উচিৎ। এতে চা শ্রমিকরা যেভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে শিক্ষা-দীক্ষা থেকে, তা অনেকাংশেই রোধ হবে। তাহলে একদিকে যেমন একটি ভাষা সংরক্ষিত হবে, অপরদিকে যারা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান জানানোর দায়িত্ব পালন হবে।