বাগেরহাটের চিতলমারীর বজলু খন্দকারের ছেলে সুজন মন্দির রোডের ভাড়া বাসায় থাকেন এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে। বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। গানের সুর আর কথার ছন্দে সাপের খেলা দেখান সুজন। গত মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের কারণে তার খেলা দেখানো বন্ধ হয়ে যায়। তবে সাপ ধরা বন্ধ হয়নি।
সরকারি বিধিনিষেধ থাকলেও সম্প্রতি বাধ্য হয়ে আবারও খেলা দেখানো শুরু করেছেন এ সাপুড়ে। ভৈরব নদের পাড়ে মাঝে মাঝে খেলা দেখান। কিন্তু এখন খেলা দেখে মানুষ টাকা দিতে চায় না। খেলা দেখিয়ে কখনও যেমন ঘণ্টায় ৫০০ টাকা আয় হয়, আবার কখনও কোনো টাকাই পান না। এভাবেই জীবন চলছে, তবে হাল ছাড়েননি। সাপের খেলার পাশাপশি মানুষের ভাগ্য বলে দিয়ে মাঝে মাঝে তাক লাগিয়ে দেন খেলা দেখতে আসা দর্শকদের। এ সময় অনেকেই তার কথায় মোহিত হয়ে কিনে নেন নানা ধরনের ভেষজ ওষুধ।
সাপুড়ে সুজন বলেন, ২৫ বছর আগে এ জীবন শুরু করেন। আগে শহর-গ্রাম সবখানেই সাপের দেখা মিলত। সব সময় তিনি ব্যস্ত থাকতেন বিভিন্ন এলাকায় সাপ ধরতে, আয়ও ভালো ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেশে সাপের উপদ্রব নেই বললেই চলে। ‘মাঝে মধ্যে ডাক পাই। বর্তমানে যে কোনো সাপ ধরতে গেলে কমপক্ষে হাজার টাকা নেই। পাশাপশি শহর ও গ্রামে সাপের খেলা ও ওষুধ বিক্রি করে দিনে গড়ে ৪০০-৫০০ টাকা আয় হয়।’
আরও পড়ুন: রাজধানীতে ৭৫ কোটি টাকার সাপের বিষসহ আটক ৬
লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা: পাইকগাছায় স্থানীয়দের নাভিশ্বাস
সুজন জানান, দেশে সাপের তেমন দাম নেই। তারা যে সাপ ধরেন তা শুধু বেদেরাই সংগ্রহ করে খেলা দেখানোর জন্য।’
করোনার আগে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে তার ডাক পড়ত জানিয়ে তিনি বলেন, সাপের খেলা দেখিয়েছেন বিয়ে বাড়িতেও। প্রতিটি অনুষ্ঠানে তিনি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পেতেন। কখনও কখনও এর চেয়েও বেশি পেতেন। কিন্তু করোনার শুরু থেকে সব অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
সুজন জানান, সাপ পোষা অত্যন্ত বিপদজ্জনক ও ব্যয় বহুল। সাধারণত সাপকে ব্যাঙ, কুচে ও মাছ খেতে দেয়া হয়। তবে সপ্তাহে অন্তত দেই দিন শিং মাছ না দিলে সাপের স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না, ঝিমিয়ে পড়ে। এছাড়া যে কোনো সাপের বিষদাঁত ভেঙে দিলে আবারও দাঁত ওঠে। এ জন্য নিয়মিত পরীক্ষা করতে হয়। দাঁত উঠলে আবার সাবধানে সেটা ভেঙে দিতে হয়।
তার দাবি, তার চিকিৎসায় সাপে কাটা রোগী সুস্থ হয়ে যায়। গত ২৫ বছরে তিনি যাদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেছেন তারা অনেকেই আবার তার কাছে রোগী পাঠান।
তার প্রতিবেশী আজিবর গাজী ও মো. সবুর বলেন, আগে সাপের খেলা দেখে লোকে যা দিত তাতে সুজনের সংসার চলত কিন্তু বর্তমানে করোনার কারণে কেউ আর খেলা দেখে টাকা দিতে চায় না। এ জন্য সুজনের আর্থিক অবস্থা এখন ভালো না।
খুলনা জেলা কালচারাল অফিসার সুজিত কুমার সাহা বলেন, ‘সরকারি ব্যবস্থাপনায় শিল্পকলার সাথে যারা যুক্ত রয়েছেন তাদের জন্য দুর্যোগকালে শিল্পকলা ভূমিকা রেখেছে। তবে যারা সাপের খেলা দেখায় তাদের বেদে সম্প্রদায়ের ভ্রাম্যমাণ মানুষ হিসেবে ধরা হয়, এ জন্য এদের চিহ্নিত করা বেশ কঠিন।’
আরও পড়ুন: ভালো নেই কুষ্টিয়ার ঝাড়ু শিল্পের কারিগররা, শত বছরেও জোটেনি স্বীকৃতি
ঠাকুরগাঁওয়ে সাপের কামড়ে যুবকের মৃত্যু
তিনি বলেন, ‘সাপুড়ে সম্প্রদায়ও আমাদের সংস্কৃতির অংশ, এদেরও তালিকাভুক্ত করা উচিত। শুধু সাপুড়ে না, যে বিষয়গুলো আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে আমরা দেখে আসছি, যারা এই ধারাগুলোকে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা যদি শিল্পকলার সাথে সরাসারি সম্পৃক্ত থাকেন তবে তাদের আমরা তালিকাভুক্ত করতে পারব। তারা তখন সরকারি সব ধরনের সহযোগিতার আওতায় আসবে।’
খুলনা বিভাগীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, ‘বেদে বা সাপুড়ে সম্প্রদায় আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ, এরা যুগ যুগ ধরে রয়েছে। সাপ বা বানরের খেলা দেখিয়ে তারা রোজগার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এদের মধ্যে বন্যপ্রাণী পাচার বা বাণিজ্যিক কোনো বিষয় জড়িত নেই।’
খুলনা নগর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি মোল্লা মারুফ রশিদ বলেন, খুলনাঞ্চলের বিভিন্ন সংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে তারা দীর্ঘ এক যুগ ধরে কাজ করছেন। নৌকাবাইচ, সাপ খেলা, লাঠি খেলা, বানর নাচ, ঘুড়িওড়ানো, হাডুডু, গল্লাছুটসহ নানা ঐতিহ্য নিয়ে তারা দীর্ঘদিন নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পৃষ্টপোষকতা করে আসছেন।
তিনি বলেন, সাপ খেলা খুলনা অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় ঐতিহ্য হলেও যথাযথ পৃষ্টপোষকতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সাপুড়ে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্টপোষকতার পাশাপাশি যদি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সামনে সাপের খেলা তুলে ধরা যায় তাহলে এ শিল্পটি নতুনভাবে এগিয়ে যাবে।