ঢাকা, ২৩ জুলাই (ইউএনবি)- চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছে সাত হাজার ১৭৯ জন। এর মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার ইউএনবিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইউএনবিকে বলেন, সাধারণত আক্রান্তের মাত্র ১০ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হয়। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি হবে এটা সহজেই অনুমেয়।
গত রবিবার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান হবিগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. শাহাদত হোসেন (৫৩)। তিনি ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ নিয়ে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েই তোলপাড় শুরু হয়েছে।
হবিগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাহ আলম জানান, গত ৯ জুলাই ঝালকাটি সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা থেকে পদোন্নতি পেয়ে হবিগঞ্জে জেলা সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করেন ডা. শাহাদত। ঢাকায় থাকা পরিবারের সাথে কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে গত ২০ জুলাই জ্বর নিয়ে কর্মস্থলে যোগদান করেন তিনি।
শাহ আলম আরও জানান, ওইদিন দুপুরে জ্বর বেড়ে গেলে তাকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে ঢাকায় পাঠান এবং রবিবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
এ নিয়ে সরকারি হিসেব মতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৬ জনে দাঁড়াল। তবে বেসরকারি হিসেবে মতে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।
শুধুমাত্র গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৪৭৫ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে খোদ ঢাকাতেই ৪৭৩ জন ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া খুলনায় দুজন ভর্তি হয়েছে। আর ঢাকায় হেমোরজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন দুজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেব মতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ৯৯ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৫২ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১৬ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৪৩ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৬০ জন, বারডেম হাসপাতালে ১৫ জন, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৩ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৬ জন, পিলখানা বিজিবি হাসপাতালে ৫ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এক জন এবং বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে ১৩১ জন ভর্তি হয়েছে।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ৭০৯৮ জন ভর্তি হয়েছে। ঢাকা শহরের বাইরে ঢাকা বিভাগে এ সংখ্যা ২৮ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগী চট্টগ্রামে ৮ জন এবং খুলনায় ৩৭ জন।
তবে আশার কথা হলো এ পর্যন্ত ৫৫০৯ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। সরকারি হিসেব মতে এখনো ১৬৬৫ জন রোগী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসাপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা আরও বেশি দাবি করা হচ্ছে মর্মে প্রশ্ন করা হলে হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার ইউএনবিকে বলেন, সরকারি হাসপাতালের তথ্য ঠিক থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলো অনেক সময় তথ্য সরবরাহ করতে চায় না। তাই হিসেবে কিছুটা গড়মিল থাকতে পারে।
এ ব্যাপারে মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের ডেঙ্গু সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের সময় কোনো ডেঙ্গু রোগী পেলে রক্ত সংগ্রহ করে তাদের কাছে নমুনা ও রোগী-সংক্রান্ত তথ্য পাঠাতে বলা হলেও তারা পাঠাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হামপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র রায় বলেন, ‘এ সময়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে কয়েক দিনেই ডেঙ্গু পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়।’
রাজধানীর পশ্চিম মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা রুনা চৌধুরী জানান, তার স্কুল পড়ুয়া দুই সন্তানই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। প্রথমে বড় মেয়েটি আক্রান্তের কয়েকদিন পরই ছোট ছেলেটা আক্রান্ত হন।
তবে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা নেয়ার পর দুসন্তানই এখন সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরছেন জানিয়ে রুনা বলেন, ‘এখনও ওদের শরীরে বেশ দুর্বলতা রয়েছে।’
সন্তানরা সুস্থ হলেও কয়েকদিনের ভোগান্তির কথা মনে করতেই অন্যান্য অভিবাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চাইনা কারও সন্তান এমন বাজে অসুস্থায় পড়ুক। কয়েকদিনে অফিস-বাড়ি ও হাসপাতাল যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহা-পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী ইউএনবিকে বলেন, ‘ডেঙ্গু থেকে বাঁচার মূল উপায় হলো সচেতনতা। বাসার আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা, সময়মতো ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডেঙ্গু নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।’
ডেঙ্গু কীভাবে ছড়ায় প্রশ্ন করলে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রশিক্ষক মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, ডেঙ্গু এডিস মশার কারণে হয়। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।
ডেঙ্গু কীভাবে চিনব এ প্রশ্নে ডা. মাহমুদুন্নবী মাসুম বলেন, ’ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। গায়ে রেশ হতে পারে। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব হতে পারে।’
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রিফাত হোসেন নামে একজন কর্মকর্তা জানান, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ডেঙ্গুর জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে 09611000999-1 নাম্বারে ফোন করে যে কোনো অধিবাসী নাম, মোবাইল নম্বর এবং ঠিকানা জমা দিলে সিটি করপোরশেনের চিকিৎসক ওই রোগীর সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়।
‘প্রয়োজন হলে রোগীর বাসায় চিকিৎসক উপস্থিত হন এবং প্রয়োজনীয় সেবা দেন,’ যোগ করেন তিনি।
যোগাযোগ করলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মমিন ইউএনবিকে বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এরমধ্যে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের সচেতন করা, মসজিদের ইমামের মাধ্যমে মুসল্লিদের সচেতন করা এবং স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতন করার কর্মসূচি রয়েছে। মঙ্গলবার হট লাইন চালু করা হবে। চিকিৎসকদের একটি টিম ২৪ ঘণ্টা উপস্থিত থাকবেন এবং রোগিদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দেবেন।