ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও সুনামগঞ্জ জেলার হাওর (জলাভূমি) এলাকায় ফসল রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
সাধারণত আগাম বন্যা ও ভাঙন থেকে ফসল রক্ষার জন্য শস্য সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। হাওর বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত জলাভূমি বাস্তুসংস্থান। অসংখ্য হাওরের জন্য সুনামগঞ্জ জেলা বিখ্যাত।
পানিসম্পদ, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সম্প্রতি হাওর পরিদর্শনে এসে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত ফসলরক্ষা বাঁধের প্রকল্প গ্রহণ না করার স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সুনামগঞ্জ জেলায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াও বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নিয়োজিত উপজেলা কমিটিকেও অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এসব নির্দেশনার পরও সংশ্লিষ্টরা তা মানছেন না। বেড়েই চলছে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের তালিকা। চূড়ান্ত প্রকল্পগুলো উন্মুক্ত না করে গোপন রাখা হয়েছে এমন অভিযোগও উঠেছে।
প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্টরা ৬০০ প্রকল্প নেওয়া হবে বললেও গত বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) পর্যন্ত অনুমোদিত প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৭৫টি। এই সংখ্যা ৭০০’র ঘরে পৌঁছে যাবে বলে আভাস পাওয়া গেছে। এবার হাওরের অস্থায়ী ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে সরকারের কাছে ১২৫ কোটি টাকা প্রাথমিক বরাদ্দ চেয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রতি বছর হাওরের বরাদ্দে নেতাকর্মীদের বাড়ির সড়ক, স্থায়ী সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয়, অতিরিক্ত প্রকল্পও গ্রহণ করা হয় বলে হাওরবাসীর অভিযোগ আছে।
আরও পড়ুন: হাওরে ইজারা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপজেলায় কর্মরত এসও (সাবস্টেশন অফিসার) বাইরের জেলা থেকে মওসুমে বাঁধের প্রাক্কলন করতে আসা সার্ভেয়ারদের দিয়ে অক্ষত, অল্প ক্ষতিগ্রস্ত প্রকল্পেও সমান বরাদ্দের বাজেট করে নেন। এবারও একই কারণে বাঁধের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এতে সরকারি অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি অপরিকল্পিত ও অতিরিক্ত বাঁধ হাওরের স্বাভাবিক প্রকৃতিরও ক্ষতি করবে বলে বিভিন্ন ফোরামে দাবি জানিয়ে আসছেন হাওর আন্দোলনের নেতারা।
গত সপ্তাহে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানিয়েছিলেন চলতি মওসুমে ৬শ’র অধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হবে না। গত ২৬ নভেম্বর হাওর পরিদর্শনে আসেন সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি ওইদিন সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন পরিবেশের ক্ষতি করে এমন কোনো অতিরিক্ত প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না। গত ৫ ডিসেম্বর ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণসংক্রান্ত জেলা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া শাল্লা উপজেলায় গিয়েও হাওরের বাঁধে প্রয়োজনের চেয়ে এবার কম টাকা লাগবে বলে মন্তব্য করে প্রচ্ছন্নভাবে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ না করার নির্দেশনা দেন। প্রকল্প বাস্তবায়নে যারা জড়িত তাদেরকেও তিনি এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দিয়ে আসেন।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৭৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই সংখ্যা সাতশর ঘরে গিয়ে পৌঁছাবে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে। গত বছর জেলায় ৭৩৪টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যার প্রায় শতাধিক অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত বলে সংবাদ সম্মেলন, সমাবেশ ও স্মারকলিপি দিয়ে প্রতিবাদ করেছিল হাওর বাঁচাও আন্দোলন। তারা অতিরিক্ত এই প্রকল্পের
পাশাপাশি অল্প ক্ষতিগ্রস্ত, অক্ষত প্রকল্পেও সমান বরাদ্দ দিয়ে সরকারি অর্থ হাতানোর পাঁয়তারা করা হয় এমন অভিযোগ করেছিল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, চলতি মওসুমে ৫৩টি হাওরের ৫৩৪ কিলোমিটার ফসলরক্ষা বাঁধ সংস্কার ও মেরামতে ১২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৫৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ৫৩টি হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ পুনঃনির্মাণ, সংস্কার ও মেরামত করতে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) কাজ করবে। এবার ১০৫টি ক্লোজারেও (বড় ভাঙ্গন) কাজ করা হবে। আগামী ১৫ ডিসেম্বর ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে ২৮ ডিসেম্বর কাজ শেষ করার কথা।
হাওর আন্দোলনের নেতারা জানান, প্রতি বছর প্রকল্প বাড়িয়ে সরকারি বরাদ্দ লোপাটের ধান্দায় থাকা সিন্ডিকেট এবারো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে প্রকল্প বাগিয়ে নিতে তৎপর হয়ে ওঠেছে। তারা নানাভাবে তদবির করে ইতোমধ্যে সফলকামও হয়েছে। শাল্লা, দিরাই, তাহিরপুর ও শান্তিগঞ্জসহ কয়েকটি উপজেলায় প্রকাশ্যে এই তৎপরতা শুরু হয়েছে।
হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত জেলা কমিটির সদস্য ও এবি পার্টির জেলা কমিটির আহ্বায়ক জসিম উদ্দিন বলেন, প্রতি বছরই হাওরের বরাদ্দ লোপাট করতে নানা ফন্দিফিকির করা হয়। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের সঙ্গে অল্প ক্ষতিগ্রস্ত ও অক্ষত প্রকল্পেও সমান বরাদ্দ দিয়ে নকশা করেন সার্ভেয়াররা(ভূমি জরিপকারী)। পিআইসি সিন্ডিকেটের লোকজন ঘুষ দিয়ে এসব প্রকল্প নিয়ে ব্যবসা করে। এবার সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সচেতন থেকে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প না বাড়ানোর নির্দেশনা দিলেও সেটি মানা হচ্ছেনা। ঘোড়ার মতো লাফিয়ে বাড়ছে প্রকল্প সংখ্যা। পিআইসি’র সেই সিন্ডিকেট তৎপর হয়ে ওঠেছে এবারও।
শাল্লা উপজেলা কৃষকদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক একরামুল হোসেন বলেন, যে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়েছে কাজ শুরুর আগে এবং ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়ার আগে উন্মুক্ত করা হোক। তাহলে স্বচ্ছতা আসবে। নাহলে গোপন রেখে অনুমোদন দেওয়া হলে দুর্নীতি ও অনিয়ম থাকবেই। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোতে আগের সিন্ডিকেট তাদের স্বজনদের নামে গ্রহণ করাচ্ছে এসব জানতে পারছি আমরা।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মোহাম্মদ মনির বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দিয়ে হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধের অনিয়ম না করার অনুরোধ জানিয়েছি। নীতিমালার আলোকে গণশুনানি করে পিআইসি গ্রহণের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কৃষকদের মতামত নিয়ে প্রকল্প তালিকা উন্মুক্ত করতে হবে। বাঁধের সিদ্ধান্ত নেবেন কৃষকরাই। এভাবে করা হলে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের সুযোগ থাকবেনা। সরকারি অর্থও অপচয় হবেনা এবং প্রকৃতিরও ক্ষতি হবেনা। এবার বাঁধ নির্মাণকাজে অনিয়ম হলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, আমরা খুব সাবধানে এবার প্রকল্প গ্রহণ করছি। কোনো অনিয়ম যাতে না হয় স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। এ পর্যন্ত ৬৭৫টি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। আরও কিছু বাড়তে পারে।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, আমরা শুরু থেকেই পিআইসি গঠন অনিয়মমুক্ত করার চেষ্টা করছি। যে মনিটরিং কমিটি করা হয়েছে তাদেরকে ১২টি উপজেলায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তারা ঘুরে এসে আমাদের প্রতিবেদন দেবেন। আমরা ব্যবস্থা নেব।
আরও পড়ুন: কাদের দাপটে হাওরের দেশীয় প্রজাতির ধান হারিয়ে যাচ্ছে জানালেন কৃষকেরা