আমেরিকায় পুলিশ নির্যাতন বিষয়ে একাডেমিশিয়ান ও এক্টিভিস্টরা খুব সরব। আমাদের এ বিষয়ে পড়াতেন প্রফেসর টিম শেফার। উনার এক ভাই স্কুল শ্যুটিংয়ের সাথে জড়িত থাকায় সাজা ভোগ করে। সেই থেকে উনি অস্ত্র আইন, মামলা, পুলিশি নির্যতন এসব বিষয়ে কাজ শুরু করেন। গতবছর উনার একটা গবেষণা কাজে আমরা ১১ শিক্ষার্থী সাহায্য করেছিলাম। আমরা পাবলিক ফোরামে জনমত দেখতে চেয়েছিলাম, পুলিশের শরীরে ক্যামেরা বসানোর পক্ষে ও বিপক্ষে মানুষ কী ভাবছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, অধিকাংশ মানুষই বলেছে, এটা বাধ্যতামূলক করা গেলে পুলিশের জবাবদিহি বাড়বে, রেসিয়াল প্রোফাইলিং কমবে এবং সোশ্যাল জাস্টিস সিস্টেমের উন্নয়ন হবে। আজকে এ বিষয়গুলোর দিকে আলোকপাত করব।
পুলিশি নির্যাতন (পুলিশ ব্রুটালিটি) বলতে সহজ কথায় যেটা বুঝি সেটা হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী কর্তৃক অন্যায়ভাবে সাধারণ নাগরিকদের ওপর নির্যাতন। এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা। দেশে দেশে পুলিশি নির্যাতনের চেহারা হয়ত ভিন্ন, কিন্তু দিন শেষে যে সমস্যাটা এক তা হলো, মানবাধিকার লঙ্ঘন। আজকের লেখায় তথ্য উপাত্ত ঘেটে দেখতে চাই আসলে আমেরিকার মতো দেশ, যারা কি না মানবাধিকারের বিষয়ে সরব, তারা কেন পুলিশি নির্যাতন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
শুরুতেই যে সমস্যা আলোচনা করা দরকার তা হলো, কিছু কিছু অপরাধের শাস্তি কী হবে তা নিয়ে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেই বিভেদ আছে। যেমন ধরুন, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য সব স্টেটে পুলিশ চালকের প্রতি ‘অবজেকটিভলি রিসোনেবল’ আচরণ করে না। কেউ কেউ গাড়ি থামিয়ে জেরা করে। মামলা দেয়। আবার কখনও কখও পুলিশ গুলিও চালায়। অর্থাৎ, যা বলতে চাইছি তা হলো, এখানে একটা ‘ইনকনসিসটেন্ট স্ট্যান্ডার্ড’ কাজ করে। এর ফলে পুরো ব্যাপারটা আরও বেশি দুর্বোধ্য হয়ে উঠে। আমেরিকান লিগ্যাল স্কলাররা বলছেন, পুলিশি নির্যাতন একটা সিস্টেমেটিক সমস্যা। পুলিশ যখন অন্যায় করে, আইনত নাগরিকের অধিকার আছে সেই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার। কিন্তু তাদের কি বিচার হয়? ২০০০-২০০২ সালে শিকাগো পুলিশ ডিপার্টমেন্টে পুলিশ কতৃর্ক নাগরিকদের হয়রানি বিষয়ে ১০,০০০ অভিযোগ জমা পড়ে। অথচ, কৃত কর্মের জন্য সাজা ভোগ করে মাত্র ১৯ জন পুলিশ অফিসার (ক্রিটিয়ান, ২০১৪)। এ বিষয়ে ইউএস টুডে সম্পদকীয়তে বলা হয়, পুলিশের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের ৯৫ শতাংশ কেসেই কোনো অফিসারের সাজা হয় না। কারণ এসব কেস ফেডারেল কোর্টে পাঠানো হয়। সেখানে অনেক সময় ভিক্টিমকেই প্রমাণ করতে হয় যে তিনি পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সাধারণ নাগরিকের পক্ষে এত এত উপযুক্ত প্রমাণাদি যোগাড় করা চারটিখানি কথা নয়। ফলে অধিকাংশ সময় ভিক্টিমের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয় এবং অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের আর কোনো সাজা হয় না। তারচেয়েও জঘন্য ব্যাপার হলো, অনেকগুলো স্টেটেই সাজাপ্রাপ্ত পুলিশের প্রতি নির্ধারিত ফাইনের টাকা পরিশোধ করা হয় মূলত পুলিশ বাহিনীর জন্য নগরীর (সিটি) বরাদ্দকৃত খাত থেকে। এর ফলে পুলিশি ন্যাগলিজেন্স বাড়ছে বলে মনে করেন স্কলাররা।
এরপরে যে কারণটি লিগ্যাল স্কলাররা চিহ্নিত করেন, সেটি মূলত রেসিজম। আমি মনে করি, রেইস একমাত্র উপাদান নয়, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনা। ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মিসৌরির সেন্ট লুইস এলাকায় ১ বছরে যে পরিমাণ গাড়িকে পুলিশ থামিয়েছে, তার ৪৬ শতাংশই মূলত সে এলাকার বাসিন্দা নয়। এবং যেসব স্থানে পুলিশ সাধারণত গাড়ি থামিয়ে চেক করে, ডেমোগ্রাফিক বিবরণ অনুসারে সেই সব জায়গার অধিকাংশই কালোদের বসতিস্থল (দি কনভারসেশন, ২০১৮)। পুলিশ কি তাহলে শ্বেতাঙ্গ আইন অমান্যকারীদের থামায় না? অবশ্যই থামায়। তবে রেসিয়াল প্রোফাইলিংয়ের শিকার মূলত অশ্বেতাঙ্গরাই বেশি। ২০১৩ সালে গবেষক রেডলি বালকোর লেখা এক বইতে বলা হচ্ছে, গত ২ দশকে পুলিশ বাহিনীতে অস্ত্র সজ্জিত সোয়াত বাহিনী ও অনান্য সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৫০০ শতাংশ। আমি বলছি না, সদস্য বাড়লেই পুলিশি নির্যাতন বাড়বে, কিন্তু এত বিশাল বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা বা যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে।
সবশেষে, যে বিষয়টি বলতে চাই, পুলিশের শরীরে বডি ক্যামেরা বসালেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে? হয়ত হবে না, তবে এটুকু দেখা গেছে যে এর মধ্য দিয়ে অতীতে জবাবদিহি বেড়েছে। ন্যাগলিজেন্স বা অবহেলা কমেছে। ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৮৪ শতাংশ পুলিশ সদস্য বলেছে তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজের নামে বা সহকর্মীর নামে অভিযোগ জানাবে না। এর ফলে অনেক ব্রুটালিটির ঘটনা আড়ালে পড়ে থাকার সম্ভাবনা থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে বডি ক্যামেরা একটা ফিজিক্যাল এভিডেন্স। ২০১৪ সালে ফার্গুসানে পুলিশি হত্যার পর আন্দোলন সংগ্রামের এক পর্যায়ে সবাই মিলে পুলিশের শরীরে ক্যামেরা বসানোর জন্য প্রশাসনকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে। ওবামা সরকার এ প্রকল্পে ২৩ মিলিয়ন ডলার খরচও করে। ২ স্টেটে এটা বাধ্যতামূলত করা গেলেও সব স্টেটে সম্ভব হয়নি। অথচ, এই বডি ক্যামেরা যুক্ত করার ফলাফল বেশ চমকপ্রদ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বডি ক্যামেরা যুক্ত করার ফলে পুলিশের প্রতি অভিযোগ দায়ের করার হার ৮৮ শতাংশ বেড়ে গেছে, আর পুলিশ কর্তৃক জোরপূর্বক নির্যাতনের মাত্রা ৬০ শতাংশ কমে গেছে (ক্রিশ্চিয়ান, ২০১৪)। বাংলাদেশে আমেরিকার মত রেসিয়াল সমস্যা নেই। আয়তনেও ছোট। ফলে বাংলাদেশ চাইলে পুলিশ সদস্যদের সবার জন্য বডি ক্যামেরা বাধ্যতামূলত করার কথা ভাবতে পারে। মানছি এ প্রকল্প ব্যয়বহুল, কিন্তু পুলিশ সদস্য দ্বারা ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের মতো নানা বিতর্কে এটি একটি সমাধান হতে পারে। বডি ক্যামেরা একজন ব্যক্তির স্বাধীনতায় কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে, সে আলোচনা অন্য দিনে অবশ্যই করব। আজ এটুকু বলে শেষ করতে চাই যে দিনশেষে আমরা সবাই প্রত্যাশা করি সোশ্যাল জাস্টিস সিস্টেম আরও শক্তিশালী হোক।
লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী ও গবেষক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।