প্রথমত, ১৯৬৪ সালের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট অ্যাক্টের কথাই ধরুন। এই আইনের মাধ্যমে স্কুল-কলেজ, বাস-ট্রেন যে কোনো পাবলিক প্লেসে (জনপরিসব) সাদা-কালো ভিত্তিতে বৈষম্য আইনত বন্ধ করা হয়। এখন তহলে আরো একটু পেছনে যেতে হবে। আফ্রিকান আমেরিকান সাহসী নারী রোজা পার্ক পাবলিক বাসে শ্বেতাঙ্গ পুরুষের কাছে সিট ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ১৯৫৫ সালে। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে তখন আমেরিকার শহর থেকে শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫৬ সালে এসে ফেডারেল কোর্ট রায় দিতে বাধ্য হলো যে পাবলিক প্লেসে বর্ণভেদে বৈষম্য করা চলবে না। সুপ্রিম কোর্টও সেই রায়ে সম্মতি দেয়। আপনি কি ভাবতে পারেন, আজ থেকে মাত্র ৫০-৬০ বছর আগেও এমন ঘটনা আমেরিকার সমাজে খুব সহজাত ছিলো?
তারপরে ধরুন, ১৯৬৫ সালে শিকাগো ফ্রিডম মুভমেন্ট হলো। এই আন্দোলনের মূল ছিলো বাসস্থান, শিক্ষা, চাকুরি, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বর্ণভেদে বৈষম্য নিরসন করা। সে সময় সাদারা কালোদেরকে বাসাবাড়ি মর্গেজ দিচ্ছিলো না। আলাদা পল্লীতে তারা মানবেতর জীবন যাপন করতো। এই আন্দোলন ১৯৬৭ সাল অবধি চললো, এবং পরবর্তীতে ১৯৬৯ এ এসে " ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্ট" পাস হলো। তার মানে, বাসের সিট বলুন, বা বাসাবাড়ির মর্গেজ বলুন, সবকিছুর জন্যই আসলে তাদের প্রতিবাদ করতে হয়েছে। আন্দোলন করতে হয়েছে। রক্ত দিতে হয়েছে। আবার বর্তমান সময়ে আসেন। ২০১৮ সালের গবেষণা বলছে, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, ল্যাটিনো, এশিয়ান এরকম যত রেসিয়াল জনগোষ্ঠী আমেরিকাতে আছে, তার মধ্যে বাসস্থানহীন (হোমলেস) হিসেবে শীর্ষ আছে আফ্রিকান-আমেরিকান/কালোরা। খোদ নিউইয়র্ক রাজ্যে প্রতি ১০,০০০ জন কালো মানুষের মধ্যে ২০৮ জন বাসস্থানহীন (মোজেস, ২০১৮)। ফলে, এটা বলা যায়, যদিও সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু কালোরা কার্যত এখনো পিছিয়েই রয়ে গেছে।
তারপরে ধরুন শিক্ষা ব্যবস্থার কথা। ১৯৫৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছে বর্ণভেদে পৃথক (সেগরিগেটেট) স্কুল বেআইনি। অথচ ১৯৫৭ সালে আরক্যানসাসের লিটল রক সেন্ট্রাল হাই স্কুলে কালো ছাত্রদের প্রবেশ করতে দিলো না। যথারীতি আবার প্রতিবাদ, আবার সংগ্রাম। তারপর একসময় আমেরিকান স্কুলগুলোতে কালোদের প্রবেশাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু প্রবেশাধিকার পেলেও "স্কুল টু প্রিজন পাইপলাইন" বন্ধ হলো না। ডিসিপ্লিনারি একশনের নামে বছরের পর বছর যে বৈষম্য ঘটেছে, গবেষণায় তার ফলাফল এলো, "স্কুল টু প্রিজন পাইপলাইন" এর কারণে আফ্রিকান আমেরিকান ছাত্রদের ঝরে পড়ার হার সাদাদের তুলনায় ৩ গুণ (আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ, ২০১২)। তারপরে ধরুন, আমেরিকান ইউভার্সিটি বা হায়ার স্টাডিজ একাডেমিয়া। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, শিক্ষক, কর্মচারী, গবেষকসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সামগ্রিকভাবে সব পদের ৭৩.২ শতাংশ দখল করে আছে শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীরা (এএসিইউ, ২০১৯)। কল্পনা করা যায়? তারপরেও আপনি বলবেন, এ সমাজে হোয়াইট প্রিভিলেজ বা রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশন নেই? এত সংগ্রাম, রক্ত, সময়ের বিবর্তনে তাহলে পরিবর্তনটা কোথায়?
তারপরে ধরুন, আফ্রিকান আমেরিকানরা দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করেছে, জিম ক্র ল' নিয়ে। একটা সময় তো সাদা আর কালো ইন্টাররেসিয়াল বিবাহ অসম্ভব ছিল। আলাবামাতে হাসপাতালে আফ্রিকান আমেরিকান পুরুষ রোগীকে শ্বেতাঙ্গ নার্সরা (সেবক-সেবিকা) সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারতো। এরকম শত শত ঘটনা আছে। এই বিভাজন, বৈষম্যগুলো ভাঙতে অনেক সময় লেগেছে। অথচ দেখুন, আজকে এত বছর পরে এসেও ২০১৯ সালে সারা বিশ্ব দেখলো মিসিসিপি রাজ্যের একটি বিবাহ হলে শ্বেতাঙ্গ কনে আর কৃষ্ণাঙ্গ বরের বিবাহ আয়োজনে অস্বীকৃতি জানালো কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, কিন্তু ২০১৯ সালে এসেও যদি এসব ঘটনা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়, তবে দুঃখজনক। তার মানে, পরিবর্তন আসলে কতটা এসেছে?
এরকম বলতে গেল ফিরিস্তির শেষ নাই। সর্বশেষ পুলিশি নির্যাতনের ঘটনায় মানুষ ফুসে উঠেছে। শুধু ২০১৯ সালেই ১০৯৮ জন পুলিশের গুলিতে মারা যায়। পরিসংখ্যান বলছে, পুলিশের গুলিতে কালোদের মৃত্যু হার সাদাদের তুলনায় ৩ গুণ। অথচ, আগ্নেয়াস্ত্র বহন করার দিক থেকে কালোরা সাদাদের তুলনায় ১.৩ শতাংশ পিছিয়ে আছে। তারপরেও কেন তাহলে তাদের মৃত্যুহার বেশি? কারণ, ২০১৩-২০১৯ সালের হিসাব মতে, এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ে অভিযুক্ত অফিসারদের ৯৯ শতাংশকে কার্যত কোনো সাজা ভোগ করেতে হয়নি। এরপরেও কি আপনি বলবেন যে "ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার" অমূলক?
এই যে, আমি ইতিহাসের সুতার অগ্র আর পশ্চাত ধরে ধরে পরিসংখ্যান আর গবেষণা দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, এখানে শুধু সাদা আর কালোদের প্রসঙ্গ এনেছি, কেবল আলোচনার সুবির্ধাতে। আমেরিকা আসলে নানা বর্ণ, নানা জাতির দেশ। সবাইতে একসাথে ব্যাখ্যা করতে গেলে আলোচনা জটিল হবে। তারপরও সেটা আমাদের করতে হবে। এবং আমরা করবো। অন্য একদিন। আপাতত এটুকু থাক। সবশেষে, জর্জ ফ্লয়েডের আত্মার শান্তি কামনা করি। তার মৃত্যু আর এ চলমান আন্দোলন থেকে যেন আমেরিকা আরো বেশি মানবিক, মহান ও উদার হবার শিক্ষা গ্রহণ করে, সে আশা রাখতেই পারি। পরবর্তীতে আরো কথা বলা যাবে।
নোট: মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখায় লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। এর সাথে ইউএনবির সম্পাদকীয় নীতিমালার সম্পর্ক নেই।
লেখক: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি গবেষণারত।