ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক আসলে মিউকর নামক একধরনের ছত্রাক, যেটি অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে, আর্দ্রতাপ্রবণ ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় বেড়ে উঠে। যে কোনো জৈবপদার্থ, যেমন পঁচনশীল ফলমূল, সবজিতে এরা খুব সহজেই জন্মাতে পারে। মাটি, গাছপালা, সার এমনকি সুস্থ মানুষের নাক ও কফেও এটি থাকতে পারে। ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ আর্দ্রতা এদের জন্য অনুকূল আবহাওয়া। তবে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে এদের বৃদ্ধি কম হয়।
আরও পড়ুন: করোনায় তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড ভারতের, অবনতি চলমান
ছত্রাকগুলো দেখতে অনেকটা গাছের ডালপালার মতো। চারপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এদের গায়ে একধরনের কালো রঙের স্পোর বা সুক্ষ্ণ গুটির মতো বীজাণু থাকে যা খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অনেকগুলো জন্মালে তখন খালি চোখে দেখা যেতে পারে। এই স্পোরগুলা মূলত এদের প্রজনন অঙ্গ। এগুলো ফুলে রেণুর মতো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিতেও এগুলো নষ্ট হয় না।
আরও পড়নু: বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত ১৬ কোটি ৭১ লাখ ছাড়াল
কীভাবে ঘটে কালো ছত্রাক সংক্রমণ
মিউকর ছত্রাক মানবদেহে ছড়িয়ে যে ক্ষতিকর অবস্থার সৃষ্টি করছে তাকে বলা হচ্ছে কালো ছত্রাক সংক্রমণ বা ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশান’। মেডিকেলের পরিভাষায় যার নাম ‘মিউকরমাইকোসিস’।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীলের মতে, নিঃশ্বাস নেয়ার সময় কালো ছত্রাক নাক দিয়ে মানবদেহে প্রবেশ করে। বাতাসে ভেসে বেড়ানোর সময় কালো ছত্রাকের স্পোর সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে মানুষের ফুসফুসে এগুলো বংশবিস্তার শুরু করে। এরপর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
আরও পড়ুন: ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ রোধে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
এটা খুবই স্বাভাবিক যে, করোনাভাইরের কারণে বিপর্যস্ত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আবার ফিরে আসতে নূন্যতম কিছু সময়ের প্রয়োজন হয়। এই সময়টুকুতে শরীর একদম উন্মুক্ত থাকে যেকোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার জন্য। সেই সূত্রেই করোনাভাইরাস সেরে যাওয়ার পরেও নতুন করে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। মানসিক রোগ থেকে শুরু করে হার্ট বা মস্তিষ্ক- যেকোনো কিছু। আর ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশন সেগুলোরই একটি। এভাবেই মত ব্যক্ত করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক লেলিন চৌধুরী।
আরও পড়ুন: করোনায় একদিনে আরও ৩৮ প্রাণহানি, শনাক্ত ৮.৪১ শতাংশ
কেন হয় এই সংক্রমণ
এ কথা বলাই বাহুল্য যে, কালো ছত্রাক জন্ম নিতে পারে এরকম স্যাঁতস্যঁতে নোংরা পরিবেশের সৃষ্টিই এই সংক্রমণের নেপথ্যে। দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল দেশগুলোতে এ ধরনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য পূর্বে অনেক রোগের সংক্রমণ ঘটেছে। এক দিকে এরকম অনুকূল অবস্থা পেয়ে জন্ম নিচ্ছে লাখ লাখ জীবাণু, অন্য দিকে প্রতিকূল পরিবেশে ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এরই ধারাবাহিকতায় করোনা ভাইরাস সংক্রমণে মানুবদেহ সম্পূর্ণভাবে ধরাশায়ী হয়ে পড়ছে এই জীবাণুগুলোর কাছে।
আরও পড়ুন: দেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের উপসর্গ নিয়ে একজনের মৃত্যু
করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্টেরয়েড কালো ছত্রাক সংক্রমণের জন্য দায়ী। আইসিইউতে পাঠানোর আগে বা পরে চিকিৎসকগণ কোভিড রোগীদের স্টেরয়েড দেন। অনেক সময় অতিরিক্ত স্টেরয়েড দেয়ার কারণে পরবর্তীতে রোগীর শরীরে ছত্রাক সংক্রমণ ঘটে। বিষয়টি জানিয়ে বাংলাদেশের একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ঔষধ দেয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সতর্ক হতে বলেন। তাছাড়া ঔষধের পরিমিত ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলেন।
স্টেরয়েড করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুসের প্রদাহ প্রশমিত করে। শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন করোনা ভাইরাসকে ঠেকাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন শরীর কিছু ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সেই ক্ষতি নিরসণে সাহায্য করে স্টেরয়েড। একইসঙ্গে এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি করে। অতঃপর দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বা আক্রান্ত নন, তাদের প্রত্যেকেই এই জটিলতায় পড়েন। এরই ফলশ্রুতিতে রোগীরা মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত হন।
কারা সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিপূর্ণ
আইসিইউতে থাকা রোগীরা মিউকোরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণে বেশি ঝুঁকিতে পড়ছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ডায়াবেটিস, এইচআইভি পজিটিভ, ক্যান্সার বা হার্টের রোগীরাই বেশি আছেন এই সংক্রমণের ঝুঁকিতে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ফুসফুস মাত্রারিক্তিত দুর্বল থাকায় সহজেই ফুসফুসে আক্রমণ করে এই কালো ছত্রাক। এরপর তা ক্রমশ সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে রোগীকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে।
সংক্রমণের লক্ষণসমূহ
প্রাথমিক অবস্থায় অ্যালার্জির উপসর্গ দেখা দিতে পারে যেমন, সর্দি, হাঁচি–কাশি, চুলকানি ইত্যাদি। সাইনোসাইটিসের লক্ষণ দেখা দিতে পারে যেমন, মাথাব্যথা, নাক বন্ধ বা নাক দিয়ে পানি ও রক্ত ঝরা ইত্যাদি। চোখ আক্রান্ত হলে চোখ ফুলে যাওয়া, জ্বালা পোড়া করা বা চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখের পাতা ঝুলে পড়া, দৃষ্টিশক্তি কমে আসা সহ চোখের গভীরে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। অনেক সময় চোখের পাতা বা নাকের উপরিভাগের ত্বকে কালো ক্ষত দেখা দেয় এবং গাল ফুলে ওঠে। চূড়ান্ত অবস্থায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যেতে পারে। টিস্যু ক্ষয়জনিত সমস্যা যেমন, অঙ্গহানির মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফুসফুস আক্রান্ত হলে শ্বাসকষ্ট হয়।
সরাসরি অনুশীলনরত চিকিৎসকদের মতে, সংক্রমিত বেশিরভাগ রোগীই হাসপাতালে আসতে অনেক দেরি করে ফেলেন। দৃষ্টিশক্তি একেবারে হারিয়ে হাসপাতালে আসার ফলে চোখ অপসারণ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। অনেক সময় দুই চোখই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছত্রাকের ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়াটা বন্ধ করতে যেয়ে রোগীর চোয়ালের হাড়ও ফেলে দিতে হয়।
কি কি সতর্কতা নেয়া যেতে পারে
- সর্বপ্রথম কালো ছত্রাকের বংশবিস্তারের সম্ভাব্য সব রকম অনুকূল পরিবেশ নির্মূল করে বৃহৎ পরিসরে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা।
- সব সময় মাস্ক পড়ে থাকা। একটি মাস্ক একাধিকবার ব্যবহার না করা।
- মাটি (বাগান), শ্যাওলা বা সার ব্যবহারের সময় জুতা, লম্বা ট্রাউজার,লম্বা হাতা শার্ট এবং গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে।
- কালো ছত্রাক প্রতিরোধে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খাওয়া। কারণ ভিটামিন সি মানবদেহে ৬০-৮০ শতাংশ টিস্যু তৈরিতে সহায়তা করে।
- মিউকরমাইকোসিস শনাক্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা হিসেবে শিরায় এমফেটারিসিন–বি প্রয়োগ করা।
- করোনা চিকিৎসাধীন রোগী এমনকি যারা আইসিইউ-এর বাইরে আছেন, সবার ক্ষেত্রেই বিছানাপত্র যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখা। পাশাপাশি আশেপাশের পরিবেশের ওপরেও নজর রাখা।
- করোনা চিকিৎসায় ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতার সাথে পরিমিত মাত্রায় স্টেরয়েড ব্যবহার করা। এমনিক কোভিড থেকে যারা সেরে উঠছেন তাদেরকে স্টেরয়েড দেয়ার ক্ষেত্রেও যথেষ্ঠ সাবধানতা অবলম্বন করা।
- হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার পরেও রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রার দিকে চিকিৎসকদের খেয়াল রাখা।
- অক্সিজেন থেরাপির সময় হিউমিডিফায়ার বা রুমের আর্দ্রতা বর্ধক যন্ত্র পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
- অ্যান্টিবায়োটিক/ অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
শেষাংশ
যেহেতু কালো ছত্রাক সংক্রমণ একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে, সেহেতু সরকারী পর্যায় থেকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এই সংকট নিরসণ করা জরুরী। পাশাপাশি জনসাধাণের সেই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু ভারতকে কেন্দ্র করে এই জটিলতা বাড়লেও অচিরেই এই সংক্রমণ সীমারেখার ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব দক্ষিণ এশীয়ার দেশগুলো সহ বিশ্বব্যাপী এই সংক্রমণ রোধকল্পে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।