কোরবানি শব্দের অর্থ হলো- উৎসর্গ, নৈকট্য লাভ, ত্যাগ, বিসর্জন ইত্যাদি। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট পশু (প্রিয়) জবাই করাকে কোরবানি বলে। সামর্থ্যবানদের জন্য এটি ওয়াজিব ইবাদত।
ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, মহান আল্লাহ স্বপ্নের মাধ্যমে নবী হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি দিতে। আল্লাহ এর মধ্য দিয়ে তার নবীকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। স্নেহের ছেলে হযরত ইসমাইল (আ.) ছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সবচেয়ে প্রিয়। বাবা হয়ে ছেলেকে কোরবানি দেয়া অসম্ভব কাজ। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ.) বিনা দ্বিধায় নিজ ছেলেকে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মহান আল্লাহর নির্দেশে তার ছুরির নিচে হযরত ইসমাইল (আ.)-এর স্থলে কোরবানি হয়ে যায় একটি দুম্বা। স্রষ্টার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য ও ত্যাগ স্বীকারের বাণীই এ ঘটনার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে সারাবিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা জিলহজ মাসের ১০ তারিখে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রিয় পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন।
কোরবানির পশু সংক্রান্ত জরুরি বিষয়
নবী হযরত মুসার (আ.) যুগের একটি হত্যারহস্য উন্মোচনে গরু কোরবানির বর্ণনার কারণে আল কোরআনের সর্ববৃহৎ সুরার নামকরণ করা হয়েছে ‘বাকারা’ বা গরু। এ সুরার ৬৭-৭১নং আয়াতে ওই গরুর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। যা কোরবানির পশু নির্বাচনের আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচ্য। যেমন- (১) মধ্যম বয়সী হওয়া (২) হলুদ উজ্জ্বল গাঢ় বর্ণের হওয়া (৩) আকর্ষণীয় ও সুদর্শন হওয়া (৪) পরিশ্রমক্লান্ত না হওয়া (৫) সুস্থ ও নিখুঁত হওয়া।
কোরবানির পশু মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও অনুপম সৃষ্টি নৈপুণ্যের নিদর্শন। পরিবেশ ও প্রতিবেশগত কারণে কোনো কোনো বন্যপ্রাণি বিলুপ্ত এবং বিপুল উৎসাহে প্রতি বছর অসংখ্য উট, গরু ইত্যাদি কোরবানি হলেও এগুলো টিকে আছে আপন অস্তিত্বে। এজন্যই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ‘কোরবানির উট-গরুকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনস্বরূপ বানিয়েছি’ (হজ: ৩৬)।
কোরবানির পশু হতে হবে দোষমুক্ত
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) নির্দেশনা হলো- ‘কোরবানির পশুতে চারটি দোষ সহনীয় নয়— (১) স্পষ্টত অন্ধ (২) মারাত্মক অসুস্থ (৩) দুর্বল-হাড্ডিসার (৪) চার পায়ে চলতে পারে না এমন অক্ষম বা খোঁড়া’(তিরমিযি)।
অন্য এক বর্ণনায় আছে, ইবনু ওমর (রা.) এমন পশু কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন যার দাঁত নেই এবং যা সৃষ্টিগতভাবেই পঙ্গু (মুওয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ)।
অন্যদিকে পশুগুলোর জন্মের পবিত্রতা নিশ্চিত হওয়াও জরুরি। এজন্যই কৃত্রিম প্রজননের প্রাণি, বন্যপ্রাণি, চারণভূমিতে অবাধ বিচরণশীল প্রাণি কোরবানির ক্ষেত্রে পরিহার করা উচিত।
ফিকহগ্রন্থে ত্রুটিমুক্ত পশু প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। যাতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়—১. দুই চোখ বা এক চোখ এক তৃতীয়াংশের বেশি অন্ধ পশু কোরবানি চলবে না । ২. তিন পায়ে চলে বা চার পায়ে ভর দিতে পারে না এমন পশু কোরবানি করা বৈধ নয়। ৩.পশুর কান বা লেজ এক তৃতীয়াংশের বেশি কাটা থাকলে কোরবানি হবে না। ৪. মজ্জা শুকিয়ে গেছে এমন হাড্ডিসার পশুতে কোরবানি হবে না। ৫. শিং ওঠেইনি অথবা শিং অগ্রভাগ বা সামান্য ভাঙা হলে চলবে তবে শিং যদি মূল থেকে ভেঙে থাকে তাতেও কোরবানি শুদ্ধ হবে না। ৬. যে পশুর চামড়া, পশম নষ্ট বা চর্মরোগের কারণে গোশত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন পশু কোরবানি করা যাবে না। গর্ভবতী পশু কোরবানি করা বৈধ। কিন্তু বাচ্চা প্রসবের সময় অত্যাসন্ন এমন পশু কোরবানি করা মাকরূহ। কেননা ইবাদত ত্রুটিমুক্ত হওয়া জরুরি।
ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী, কোরবানি একটি উচ্চমর্যাদার ইবাদত। হাদিসের বিবরণে রয়েছে, কোরবানির পশু হাশরের ময়দানে শিং, কান, চোখ, লেজ ইত্যাদিসহ হাজির করা হবে। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ মানুষ ঈদের আনন্দে বিমোহিত হয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা ভুলে যাই। হাদিস শরিফে আছে ‘পবিত্রতা হলো ঈমানের অংশ’- সহিহ মুসলিম: ৪২৭। তাই প্রত্যেকে পশু কোরবানির শেষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।