বাংলাদেশ সহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম রাজ্যের বারাক উপত্যকার রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সহ ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ কোটি বাঙালির এই মুখের ভাষার শুরুটা খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছরেরও আরো পেছনে। মহিমান্বিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের এই মাসে চলুন জেনে নেয়া যাক অতি প্রাচীন বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি
বাংলা ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোত্রে। সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তির কিংবদন্তি থাকলেও বাংলা ভাষাবিদরা বিশ্বাস করেন, বাংলা মাগধী প্রাকৃত এবং পালির মতো ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে এসেছে।
ইন্দো-আর্য হল ইন্দো-ইরানীয় ভাষা উপবিভাগের একটি প্রধান শাখা, যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোত্রের পূর্বাঞ্চলীয় ধরন। প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চ্যাটার্জির মতে, বৈদিক এবং সংস্কৃত উপভাষাগুলোকে প্রাচীন ইন্দো-আর্য যুগের প্রতিনিধি হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষাগুলোর মধ্যে আছে পালিসহ প্রাকৃতের বিভিন্ন রূপ, যেগুলো পাওয়া যায় সম্রাট অশোক এবং থেরাবাদ বৌদ্ধ কাননের শিলালিপিতে।
আরো পড়ুন: বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস: রূপরেখায় অপশক্তির অবসান কামনায় শান্তি মিছিল
প্রথম সহস্রাব্দে বাংলা যখন মগধ রাজ্যের অংশ ছিল, তখন মধ্য ইন্দো-আর্য উপভাষাগুলোর বেশ প্রভাব ছিলো বাংলায়। এই উপভাষাগুলো মাগধী প্রাকৃত নামে পরিচিত আর এটিই ছিলো আধুনিক বাংলা, বিহার, ও আসামের লোকেদের কথ্য ভাষা। এই ভাষারই বির্বতিত রূপ অর্ধ-মাগধী প্রাকৃত, যেখান থেকে প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে উদ্ভব হয় অপভ্রংশের। অতঃপর কালক্রমে এই অপভ্রংশ থেকে একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে জন্ম হয় বাংলা ভাষার।
বাংলা ভাষার বিবর্তন
বাংলা ভাষার বিবর্তনের তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে; পুরাতন, মধ্য এবং আধুনিক বাংলা।
পুরাতন বাংলা ছিল ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার পুরোহিত এবং পণ্ডিতদের সাহিত্যকর্মের ভাষা। এই সময়ের সাহিত্যের খুব কম চিহ্নই এখন অবশিষ্ট রয়েছে। সবচেয়ে প্রাচীনতম নিদর্শনের মধ্যে একমাত্র চর্যাপদ পাওয়া যায়। এটি বৌদ্ধধর্মের উপর ভিত্তি করে কবিতার একটি সংকলন, যা অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়।
আরও পড়ুন: মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ কেন জরুরি?
চতুর্দশ শতকে বাংলায় শুরু হয় মুসলমানদের সালতানাত। সালতানাত বাংলাকে এই অঞ্চলের সরকারী দরবারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই ধারাবাহিকতায় ক্রমেই বাংলার স্থানীয় ভাষায় পরিণত হয় বাংলা।
ষোড়শ শতকে মুঘলরা বাংলা দখল করলে বাংলা ভাষার সাথে যোগসাজশ ঘটে ফার্সি ভাষার। বর্তমান বাংলা ভাষার আধুনিক রূপটি পাওয়া যায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের সময় বাংলার নদীয়া অঞ্চলে কথিত উপভাষায়। এই ভাষাটির দুটি ভাগ; শুদ্ধ এবং চলিত। এগুলোর ভিত্তি গড়েছে প্রধানত মাগধী প্রাকৃত এবং পালিসহ তুর্কি, পর্তুগিজ, ফার্সি ও ইংরেজি।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষা করার দাবিতে বাংলা ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে লালন করে। ফলে ১৯৭১ এ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
আরো পড়ুন: একুশে বইমেলার শিকড়ের সন্ধান
বাংলার উপভাষা
কথ্য বাংলায় আঞ্চলিক ভিন্নতার রেশ ধরে গঠিত হয় উপভাষা। ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চ্যাটার্জি পূর্ব মাগধী ভাষার উপভাষাগুলোকে চারটি গ্রুপে বিভক্ত করেছেন; রাঢ়ি, বঙ্গিয়া, কামরূপী এবং বরেন্দ্রী। দক্ষিণ-পশ্চিমের রাড়ী বা নদীয়া অঞ্চলের উপভাষা আধুনিক প্রমিত কথ্য বাংলার ভিত্তি তৈরি করে। বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা এবং সিলেট বিভাগের অনেকাংশে প্রচলিত উপভাষায় পশ্চিমবঙ্গের বচন ব্যবহৃত হয়।
বাংলার কিছু ধরন চাটগাইয়া এবং চাকমার স্বরের সাথে বিবর্তিত। রংপুরী, খরিয়া থার, এবং মাল পাহাড়িয়া পশ্চিমী বাংলা উপভাষার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হলেও আলাদা ভাষা হিসাবে ধরা হয়। একইভাবে উত্তর বাংলার উপভাষার সাথে মিল থাকলেও হাজং একটি পৃথক ভাষা।
১৯ শতকের শেষ এবং ২০ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার প্রমিতকরণের সময় বাংলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল ব্রিটিশ অধীন কলকাতা শহরে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উভয় ক্ষেত্রেই যেটি প্রমিত রূপ হিসেবে গৃহীত হয়েছে, তা মুলত নদীয়া জেলার পশ্চিম-মধ্য উপভাষার উপর ভিত্তি করে।
আরো পড়ুন: বাংলাদেশের শীর্ষ ১৫টি ঐতিহ্যবাহী স্থান
প্রায় ১৩০০ বছরের দীর্ঘ বিবর্তনে বাংলা ভাষার সাথে যুক্ত হয়েছে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় এবং বিদেশী শব্দ। বহু শতাব্দীর পর ১৯ শতকে এসে রাজা রাম মোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা চূড়ান্ত রূপ পায়। আজ বাংলা মানব সভ্যতার ইতিহাসে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ভাষা। বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা এবং ৩৭০ লক্ষ মানুষের দ্বিতীয় কথ্য ভাষা বাংলা। পৃথিবীর ভাষাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান পঞ্চম এবং শুধুমাত্র কথ্য ভাষা হিসেবে অবস্থান ষষ্ঠ।