বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস-২০২১ উপলক্ষে লেপ্রোসি অ্যান্ড টিবি কোঅর্ডিনেটিং কমিটির এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
১৯৫৩ সাল থেকে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষ রবিবার আন্তর্জাতিকভাবেই বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস পালিত হয়ে আসছে।
‘সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, কুষ্ঠকে করি জয়’ শ্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে সারা বিশ্বির সাথে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস-২০২১।
জাতীয় কুষ্ঠ কর্মসূচি এবং লেপ্রোসি অ্যান্ড টিবি কোঅর্ডিনেটিং কমিটি যৌথভাবে ঢাকার মহাখালীতে জাতীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে র্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, কুষ্ঠরোগ অতি পুরাতন রোগ হলেও এখনও পৃথিবীতে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ জন ব্যক্তি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসা শুরু করেন।
আরও পড়ুন: জনবল সংকটে নীলফামারীর কুষ্ঠ হাসপাতাল
দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্য কুষ্ঠ উদ্যোগকে সামনে রেখেই মূলত সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৯ সালে এক জাতীয় সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করলে ২০৩০ সালের আগেই কুষ্ঠমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য অর্জন করতে পারব।’
সেসময় প্রধানমন্ত্রী কুষ্ঠরোগীদের সমাজেরই অংশ উল্লেখ করে তাদের দূরে ঠেলে না দিয়ে কোনো ব্যক্তির দেহে কুষ্ঠ রোগ শনাক্ত হলে সহানুভূতির সাথে আচরণ করতে এবং সুস্থ হয়ে ওঠা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে এক কিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
দেশে বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস-২০২১ উদযাপন
বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস-২০২১ উপলক্ষে রবিবার সকালে রাজধানীর মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাঙ্গণ থেকে বর্ণাঢ্য স্ট্যান্ডিং র্যালি এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমবিডিসি এবং লাইন ডিরেক্টর-টিবিএল অ্যান্ড এএসপি পরিচালক ডা. সামিউল ইসলাম র্যালিটির উদ্বোধন করেন। এমবিডিসি উপপরিচালক এবং জাতীয় কুষ্ঠ কর্মসূচির (এনএলপি) প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. এনামুল হক, সাবেক প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. শেখ আব্দুল্লাহ হাদি, ডা. আদনান রাসেল এবং ড. নাইমা হক, এলটিসিসি চেয়ারম্যান এবং টিএলএমআই-বির কান্ট্রি ডিরেক্টর সলোমন সুমন হালদারসহ এবং এনএলপি ও এলটিসিসির কর্মকর্তা ও কর্মী এবং সদস্যরা এসময় উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে এলটিসিসি স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক এবং ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পরিচালক ডা. অং কা জাই মগ; লেপরা বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. ডেভিড পাহান, টিএলএমআই-বির প্রোগ্রাম সাডোর্ট কোঅর্ডিনেটর জিপ্তাহ বৈরাগী এবং এইপি প্রোজেক্ট ম্যানেজার মাসুমা পারভিন, ডেমিয়েন ফাউন্ডেশনের মেডিকেল কো-অর্ডিনেটর ডা. দিপক কুমার বিশ্বাস, হিড বাংলাদেশের ফিনান্স ডিরেক্টর নিখিল চন্দ্র সাহা, সালভেশসন আর্মির প্রোজেক্ট ম্যানেজার আলবার্ট সরকার এবং হিড বাংলাদেশের প্রোজেক্ট ম্যানেজার থমাস সিংহসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
রাজধানীতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজনের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় সিভিল সার্জন অফিস এবং কুষ্ঠ রোগসেবা প্রদানকারী বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিবসটি উপলক্ষে পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট এবং টি-শার্ট বিতরণসহ বিভিন্ন সচেতনামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
কুষ্ঠ রোগ কী
কুষ্ঠ একটি জীবাণুঘটিত মৃদু সংক্রামক রোগ যা ‘মাইকোব্যাক্টেরিয়াম লেপ্রি’ দিয়ে হয়। এই রোগে প্রান্তিক স্নায়ু আক্রান্ত হয়। বেশিরভাগই চামড়ার মাধ্যমে এই রোগের বর্হিপ্রকাশ ঘটে। চামড়ায় ফ্যাকাশে, লালচে অথবা তামাটে অনুভূতিহীন বা কম অনুভূতির দাগ, হাত বা পায়ে ঝিনঝিন অনুভূতি, অনুভূতিহীনতা, দুর্বলতা, ব্যথাযুক্ত স্নায়ু, মুখমণ্ডল বা কানের লতি ফোলা বা চামড়া পুরু হওয়া এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সবচাইতে আশার বিষয় হলো শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষের শরীরেই প্রাকৃতিকভাবেই কুষ্ঠরোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে। তবে কুষ্ঠরোগ প্রতিরোধে কার্যকর টিকা/ভ্যাকসিন এখনো আবিষ্কার হয়নি। এই রোগের চিকিৎসায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮২ সালে (মাল্টি ড্রাগ থেরাপি) ব্যবহারের সুপারিশ করে। এ পদ্ধতিতে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসা দেয়া শুরু করে।
বাংলাদেশে কুষ্ঠ রোগের সেবা
বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগের ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হয়। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন করে টিএলসিএ (টিবি অ্যান্ড লেপ্রসি কনট্রোল এসিস্ট্যান্ট) আছেন। যিনি মূলত মাঠপর্যায়ের সরকারি কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সাথে সরাসরি জড়িত। একজন ডাক্তার কোনো মানুষের শরীরে কুষ্ঠ আছে বলে নিশ্চিত করলে টিএলসিএ তার নিবন্ধন সম্পন্ন করেন ও এমডিটি চিকিৎসা দেয়া শুরু করেন। বাংলাদেশে জাতীয় কুষ্ঠ কর্মসূচির আওতায় কুষ্ঠরোগের সকল সরকারি সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি এবং অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বেসরকারিভাবে দি লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিএলএমআই-বি), ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, লেপ্রা, হিড বাংলাদেশ, ল্যাম্ব, চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টান হাসপাতাল, ধানজুড়ী কুষ্ঠ কেন্দ্র, দিনাজপুর, আরডিআরএস বাংলাদেশ এবং সালভেশন আর্মি বাংলাদেশে অত্যন্ত ফলপ্রসুভাবে কুষ্ঠ রোগীদের সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।
কুষ্ঠ রোগীদের সকলপ্রকার চিকিৎসায় তথা কুষ্ঠজনিত জটিলতার চিকিৎসায় নীলফামারীতে টিএলএমআই-বির বিশেষায়িত হাসপাতাল বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিশ্চিতকরণে দি লেপ্রোসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ পরিচালিত এই হাসপাতালের চিকিৎসক ও সেবিকারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে কুষ্ঠ রোগের চিত্র
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে কুষ্ঠ আক্রান্ত রোগীর হার প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে একজনের নিচে নামিয়ে আনা। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। তারপরেও ২০১৯ সালে সারাদেশে ৩,৬৩৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। ২০১৮ সালে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩,৭২৯ জন এবং ২০১৭ সালে ৩,৭৫৪ জন।
আরও পড়ুন: কুষ্ঠ রোগীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করুন: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষ করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে নতুন ৮৯৮ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। জাতীয় কুষ্ঠ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনো প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪০০০ মানুষ নতুন করে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসার ইতিহাস
১৮৭৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত কুষ্ঠরোগ সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ হিসেবে মনে করত মানুষ। তখন পর্যন্তও এই রোগে কেউ আক্রান্ত হলে লোকালয় থেকে রোগীকে নির্বাসন দেয়া হতো। কিন্তু নরওয়ের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডা. আরমার হ্যানসেন ১৮৭৩ সালে কুষ্ঠ জীবাণু আবিষ্কার করেন। ডা. হ্যানসেনের নামানুসারে এই রোগকে হ্যানসেন রোগও বলা হয়।
১৯৬০ সালে সালে মার্কিন বৈজ্ঞানিক জন শেফার্ড সীমিতভাবে কুষ্ঠ জীবাণুর বংশ বিস্তারের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ১৯৮২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক মাল্টি-ড্রাগ থেরাপি অনুমোদিত হয়। এই ঔষধ বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগীদে বিনামূল্যে সরবারহ করা হয়।