ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারপার্সন ড. মাহফুজা খানম এক ওয়েবিনারে বলেন, ‘আমরা প্রায়শই দেখতে পাই শিশুরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পরিবারের নারী সদস্যদের দুর্বল ও নির্বাক বলে দেখে। আধিপত্যের এ মানসিকতা আরও বেগবান হওয়ার ফলে অনেক ছেলে ও পুরুষকে নারীদের ওপর তাদের বর্বর পুরুষতন্ত্র ফলানোর বাসনাকে উস্কে দেয়।’
আরও পড়ুন: রাজধানীতে ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থীকে ‘ধর্ষণের পর হত্যার’ অভিযোগ
‘ইউএনবি লাইট অ্যান্ড লেন্স’-এর সর্বশেষ পর্বে ড. মাহফুজা বলেন, ‘শিশুদের মানসিকতা গঠনে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং কেবল ভালোমানের নৈতিকতার শিক্ষাই একজন মানুষকে এই অপরাধের বিরুদ্ধে লড়ইয়ে প্রস্তুত করতে পারে।’
ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ: প্রতিরোধ ও প্রতিকার শীর্ষক ওয়েবিনারে আলোচকরা ধর্ষণের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর বিষয়ে আলোকপাত করেন এবং একসাথে কাজ করার মাধ্যমে কীভাবে এ অপরাধের পুনরাবৃত্তি থামানো যেতে পারে সে সম্পর্কে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
আরও পড়ুন: কম্বল দেয়ার কথা বলে প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ, অভিযুক্ত গ্রেপ্তার
ইউএনবির জ্যেষ্ঠ নির্বাহী (ডিজিটাল) জাহিদ ইসলামের সভাপতিত্বে ওয়েবিনারে মার্কিন সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের ঢাকা কার্যালয়ের ব্যুরো চিফ জুলহাস আলম, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার কর্মী শিপা হাফিজা যুক্ত ছিলেন।
ধর্ষণের জন্য নারীদের দোষারোপ করার বিষয়ে বলতে গিয়ে শিপা হাফিজা বলেন, ‘আমাদের দেশের শত বর্ষের পুরোনো আইনে ধর্ষণের মামলায় নারীর শালীনতাকে মূল্যায়ন করার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং, যখন আইন নিজেই এই ধরনের মানসিকতার স্বীকৃতি দেয় তখন যে কেউ যে কোনোভাবেই নারীকে অশালীন প্রমাণ করতে পারলেই ধর্ষণের ঘটনাটি বৈধতা হারিয়ে ফেলে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা দেখতে পাই যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, মূলধারার গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষসহ প্রায় সবাই প্রায়শই চেষ্টা করে অযৌক্তিক যুক্তি দিয়ে ধর্ষণের পর বেঁচে যাওয়া নারীকে অসম্মান এবং দোষ দেয়ার।’
আরও পড়ুন: সুনামগঞ্জে চলন্ত বাসে ধর্ষণ চেষ্টা: প্রধান আসামি ৩ দিনের রিমান্ডে
অ্যাডভোকেট সালমা বলেন, ‘প্রবাদ আছে বিচার বিলম্বিত হলে ন্যায়বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। আমাদের ত্রুটিযুক্ত বিচার ব্যবস্থার কারণে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করতে না পারার বিষয়টি নির্মম সত্য।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর দিকে তাকাই, বেগমগঞ্জসহ অনেকগুলো ঘটনাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার কারণে আমাদের চোখের সামনে এসেছে। আমাদের দেশে আমরা প্রায়শই দেখেছি যে ধর্ষণ থেকে বেঁচে যাওয়াদের মামলা করতে নিরুৎসাহিত করে পুলিশ। তারপরও যারা অভিযোগ দায়ের করেন তাদের প্রায়শই অপরাধীরা দ্বারা হয়রানির শিকার হতে হয়। এই সংস্কৃতির অবসানে সরকারের পক্ষ থেকে কঠিন পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’
সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে এপি’র ঢাকা ব্যুরো চিফ জুলহাস আলম বলেন, ‘আজকাল আমরা মূল্যবোধের ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। যেখানে অনেক জাতীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিক এবং মিডিয়া মালিক ধর্ষণ থেকে বেঁচে যাওয়াদের দোষারোপের সংস্কৃতি প্রচার করছে। তাদের ভাষার ব্যবহার এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোর নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ন্ত্রণে সম্পাদকীয় নীতিমালা নেই। যেমনটা বিশ্বের নামী সংস্থাগুলোর রয়েছে।’
আরও পড়ুন: কলাবাগানে ‘ধর্ষণের’ পর হত্যার শিকার স্কুলছাত্রীকে কুষ্টিয়ায় দাফন
এছাড়াও গণমাধ্যমগুলো প্রায়শই ‘হিট অ্যান্ড রান’ প্রক্রিয়াতে কাজ করছে। আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের তাত্ক্ষণিক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে দর্শকদের কাছে তাত্ক্ষণিক সংবাদ তুলে ধরছে। তাই দুর্ভাগ্যবশত কখনও কখনও সাংবাদিকরা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সংবাদ প্রচার করছে, যোগ করেন তিনি।
সমাধানের বিষয়ে বলতে গিয়ে শিপা বলেন, ‘যথাযথ ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সরকারকে অবশ্যই আইন প্রয়োগের একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ধর্ষণ অপরাধ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে যোগাযোগ সবচেয়ে ভালো উপায়। তবে সমাজে প্রায়শই নারীদের অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করা হয় যা সবচেয়ে খারাপ একটি ব্যবস্থা। আমাদের যোগাযোগের জন্য একটি সঠিক পদ্ধতি নির্বাচন করতে হবে যা আমাদের অপরাধ সম্পর্কে সতর্ক করতে পারে এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল করে তুলতে পারে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রকল্পের মাধ্যমে এটি করা সম্ভব।’
আরও পড়ুন: ‘ধর্ষণ ও ভিডিও’ ধারণ: নাটোরে আ’লীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ২
সরকারকে মানসিক-সামাজিক সেবা, নারী এবং শিশু-বান্ধব আইনি সহায়তা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নারী ও শিশুদের বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রিক আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে বলে সুপারিশ করেন সালমা আলী।
ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলার দ্রুত বিচারের জন্য হাইকোর্টে পৃথক বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়ে তিনি এ জাতীয় মামলাগুলোর যথাযথ তদন্ত নিশ্চিত করতে আধুনিক ফরেন্সিক প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। সেইসাথে নিখরচায় ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিতেরও দরকার আছে বলে মন্তব্য করেন।
আরও পড়ুন: পুরুষ বলাৎকারকে ধর্ষণের অপরাধভুক্ত করে দণ্ডবিধির ধারা সংশোধন চেয়ে রিট