এসব এলাকায় জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ থেকে সাত ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে হাজারো পুকুর ও মাছের ঘের। নষ্ট হচ্ছে রাস্তাঘাট, কাঁচা ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষেত। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। ভাটার পানি নামলেও দুর্ভোগ কমছে না।
খুলনার কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার ৯টি গ্রাম প্রবল জোয়ারের পানিতে আবারও প্লাবিত হয়েছে। এতে ৪০ হাজার মানুষ চরম সংকটে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে- কয়রা উপজেলার কাজী পাড়া, পুটিহারী, হরিণখোলা, কাশির হাট খোলা, ঘাটাখালি ও দুই নম্বর কয়রা এবং পাইকগাছা উপজেলার মাজরাবাদ, বয়ারঋাপা ও টেংরামারী।
কয়রা উপজেলাতে রিং বাঁধ ডুবে গিয়ে গ্রামে পানি ঢুকছে এবং প্রতিদিনই জোয়ারের পানি বাড়ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে কয়রার প্রায় প্রতিটি ঘরেই তিন থেকে চার ফুট পানি ওঠে।
স্থানীয় সামাজিক সংগঠন জাগ্রত যুব সংঘের সহ-সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, ‘কয়রার কাজী পাড়া, পুটিহারী, হরিণখোলা, কাশির হাট খোলা, ঘাটাখালি, দুই নম্বর কয়রা এলাকায় হঠাৎ করে অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে ডুবেছে। আবহাওয়া বৈরি হওয়ায় হরিণখোলা, ঘাটাখালি, দুই নম্বর কয়রার রিং বাঁধের ওপর দিয়ে কপোতাক্ষ নদের পানি গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামগুলোতে ২৫ হাজার মানুষ চরম সংকটে পড়েছেন।’
কয়রার উত্তর বেদকাশি গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘বুধবার সর্বোচ্চ জোয়ারের পানি ওঠে। পানি বাড়ায় কয়রার উত্তর বেদকাশি আবারও লবণ পানিতে প্লাবিত হয়েছে।’
কয়রার গাজী পাড়ার সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘পানি কমায় কোনোমতে ঘরে ফিরে বসবাস করছিলাম। কিন্তু বুধবার দুপুরে জোয়ারের পানি আবার আমার ঘরে ঢুকে গেছে।’
অন্যদিকে উপজেলাধীন কয়রা সদর ইউনিয়নের ২নং কয়রা হরিণখোলা ও ঘাটাখালীতে কপোতাক্ষ নদের রিংবাঁধে ৫টি পয়েন্টের প্রায় ৩০০ মিটার রিংবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লোনা পানি প্রবেশ করেছে। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্থ স্থানের মেরামতের কাজ চলছে। রাতের জোয়ারের আগে রিংবাঁধ মেরামত কাজ সম্পন্ন করতে না পারলে কয়রা উপজেলা পরিষদ পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে বলে এলাকাবাসীর ধারণা।
এ ব্যাপারে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েকদিনের বৈরি আবহাওয়ায় নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানির প্রবল চাপে ২নং কয়রা হরিণখোলা ও ঘাটাখালী রিংবাঁধের ৫টি স্থানে ভেঙে লোনা পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ভাঙা রিংবাঁধগুলো মেরামতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ‘রিংবাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর পাওয়ার পর রিংবাঁধ মেরামতের জন্য পরামর্শের ভিত্তিতে সেখানে বিভিন্ন টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়েছি। সেখানে স্বেচ্ছাশ্রমে রিংবাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। রিংবাঁধ মেরামতে প্রয়োজনে সব ধরনের সাপোর্ট দেয়া হবে।’
অস্বাভাবিক জোয়ারের পানির চাপে পাইকগাছা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ উপচে এবং কোথায়ও বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
জোয়ারেরর চাপে ওয়াপদার বাহির অংশে মৎস্য ঘেরে তলিয়ে বেড়িবাঁধ উপছে পোল্ডার অভ্যন্তরে পানি ঢুকছে। এছাড়া গড়ইখালীর ১০/১২নং পোল্ডারের বাঁধ ভেঙে বাজার প্লাবিত হয়েছে। কুমখালীর ক্ষুতখালীতে বিপদজনক বেড়িবাঁধে বালুর বস্তা ও মাটি ফেলা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
অপরদিকে, বুধবার দুপুরে ২৩নং পোল্ডারের সোলাদানা ইউপির বয়ারঝাপায় ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ মেরামত করে বড় ধরনের বিপদ এড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এর আগে, কয়েক ঘণ্টার জোয়ারের পানিতে এলাকার শত-শত চিংড়ি ঘের, রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ইউপি চেয়ারম্যান এস এম এনামুল হক জানান, ভাঙন কবলিত এলাকাটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কয়েকবার ভেঙেছে, যা স্থানীয়ভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করা হয়। সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধটি মেরামত করতে গেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বাধা আসায় তা করা সম্ভব হয়নি। ফলে অমাবশ্যার জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে কোটি টাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে তিনটি গ্রামের অসংখ্য বাড়ি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী জানান, বেড়িবাঁধ সংস্কার ও মানুষের জান-মাল রক্ষার্থে প্রশাসনের সব ধরনের প্রচেষ্টা আছে এবং এ বিষয়ে ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। এলাকার শত শত মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ভাঙন কবলিত বেড়িবাঁধ মেরামত করেছেন।
তিনি আরও জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সংস্কারের প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছেন, যা অচিরেই দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে শুরু হবে। উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের ২০ (১) নং পোল্ডার বৃহস্পতিবারের অতি জোয়ারের পানির চাপে চকরি নদীর এবার দক্ষিণ মাথার পূর্বপার ওয়াপদার পাশ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গেউয়াবুনিয়া, পারমধুখালী ও চকরি বকরি গ্রামের প্রায় ৭৫০ বিঘা জমির মাছ, ধানের পাতা, বসতবাড়ি, ইট সোলিং রাস্তা ও বেড়িবাঁধ।
টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা না হলে বারবার বাঁধ মেরামত করে এলাকা রক্ষা করা সম্ভব নয়। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।