মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজিরপুর যান ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম। ঈদ শেষে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ঈদের চতুর্থ দিন গত শুক্রবার থেকে কর্মস্থলে ছুটতে শুরু করেছেন। তিনিও পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটিয়ে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রওয়ানা করেন। তবে ১২ ঘন্টার বেশি মহাসড়কে থেকে এখনও ঘাট পাড়ি দিতে পারেননি।
রবিবার সকালে ফেরি ঘাট থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার আগে দৌলতদিয়া ক্যানাল ঘাট এলাকায় আটকে থাকা অবস্থায় তাকে দূর পাল্লার পরিবহনের সামনে ইঞ্জিন কভারে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। এ সময় আলাপকালে ইউএনবির প্রতিবেদককে তিনি এসব কথা বলেন।
শরিফুল ইসলাম আরও বলেন, ঘাটে যানজটের কথা শুনে দিনের বেলা রওয়ানা করিনি। গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় বাড়ি থেকে বের হয়ে রাত ৯ টার দিকে বাসে উঠি। প্রায় ১৩ ঘন্টা ধরে বাসে বসে আছি। সঙ্গে লাগেজ রয়েছে। যে কারণে নামতেও পারছি না।
শরিফুল ইসলামের মতো ঈদ শেষে কর্মস্থলমুখী শত শত মানুষের রাত কাটছে গোয়ালন্দ ঘাট এলাকায়। নদী পাড়ি দিতে আসা শত শত গাড়ির লাইন ফেরি ঘাট থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদ পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে গাড়ির লাইন আরও দীর্ঘ হচ্ছে। গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে গরমে ক্লান্ত যাত্রীরা সিটে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আবার অনেকের জরুরি কাজ থাকায় গাড়ি থেকে নেমে গেছেন।
এদিকে দৌলতদিয়া ঘাটের চাপ কমাতে ফেরি ঘাট থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার আগে রাজবাড়ী সদর উপজেলার গোয়ালন্দ মোড় আহ্লাদিপুর এলাকায় পুলিশ গাড়ি আটকে দিচ্ছে। এসময় পণ্যবাহী গাড়ি ছাড়াও অনেক ব্যক্তিগত গাড়ি আটকা পড়ছে। কিছু গাড়ি সিরিয়াল ভঙ্গ করে আগে যাওয়ার চেষ্টাকালে পুলিশের হাতে মামলাও খাচ্ছে। এছাড়া মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারসহ শত শত ব্যক্তিগত গাড়ি গোয়ালন্দের জমিদার ব্রিজ ও পদ্মার মোড় এলাকা থেকে পুলিশ গোয়ালন্দ বাজার হয়ে উজানচর ও চর দৌলতদিয়া হয়ে অতিরিক্ত আরও প্রায় আট কিলোমিটার পথ ঘুরে ফেরি ঘাটে পৌঁছেছেন। রবিবার সকালে এ প্রতিবেদক সরেজমিন ঘুরে এমন দৃশ্য দেখতে পান।
এদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, খুলনা থেকে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ছেড়ে আসা যাত্রিবাহী দূরপাল্লার পরিবহন এখনও ঘাটে আটকে আছে। যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে কাঁচা পণ্যবাহী অনেক গাড়িও আটকে আছে। বিশেষ করে তরমুজবাহী কাভার্ডভ্যানসহ পণ্যবাহী গাড়ি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার হওয়ার সুযোগ নিয়ে ওই সব গাড়ি থেকে স্থানীয় প্রভাবশালী দালালরা পুলিশের সহযোগিতায় অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। তারপরও ১৪-১৫ ঘন্টার আগে ফেরির নাগাল পাচ্ছে না।
আরও পড়ুন: মে দিবসে পাটুরিয়া ঘাটে ভিড়
বরগুনা থেকে প্রায় ২২ টনের তরমুজ বোঝাই করে কাভার্ডভ্যান নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন ফল ব্যবসায়ী আবুল বাশার। তিনি বলেন, গতকাল শনিবার রাত ৮টার দিকে রওয়ানা করে ১১টার দিকে ঘাটে যানজটে আটকা পড়েন। স্পেশালভাবে তাদের যাওয়ার কথা বলে তাদের থেকে ১৮০০ টাকার টিকিট সাড়ে চার হাজার টাকা নিয়েছে। এরপরও প্রায় ১৩ ঘন্টা ধরে আটকে থাকায় গরমে অনেক তরমুজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রভাবশালী স্থানীয় এক ওয়ার্ড সদস্য, যুবলীগ নেতার নেতৃত্বে প্রতিটি তরমুজসহ বিভিন্ন কাঁচাপণ্য ও ফলের গাড়ি থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছেন। এতে স্থানীয় কিছু পুলিশ সদস্য সহযোগিতা করে থাকে। এদিকে বিপুল সংখ্যক যানবাহন রাজধানীর দিকে ছুটছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া কার্যালয় সূত্র জানায়, গতকাল শনিবার সকাল ৬টা থেকে রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে প্রায় ১১ হাজার ৫৯৩টি যানবাহন ফেরিতে নদী পাড়ি দেয়। ২৪ ঘন্টায় ২৬৬টি ট্রিপ দিয়ে যানবাহনের মধ্যে ছোট বা ব্যক্তিগত গাড়ি প্রায় সাত হাজার ১৯৬টি, মোটরসাইকেল তিন হাজার ২০৩টি, বাস ৮১৫টি এবং ৩৭৯টি ট্রাক পাড়ি দেয়।
আরও পড়ুন: ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় ঘরমুখো যাত্রীদের ভোগান্তির শঙ্কা
বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. শিহাব উদ্দিন বলেন, গত ২৪ ঘন্টায় রেকর্ড সংখ্যক গাড়ি পাড়ি দিয়েছে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ২১টি ফেরি চললেও গতকাল শনিবার দুপুরে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুটি ফেরি বিকল হয়ে পড়ে। পরে সন্ধ্যার আগেই বের হয়ে যায়। বর্তমানে ২১টি ফেরি ও পাঁচটি করে ঘাট সচল থাকলেও জরাজীর্ণ সড়ক এবং শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটের সমস্ত গাড়ি এই রুট ব্যবহার করায় অতিরিক্ত চাপ পড়েছে।
এদিকে দৌলতদিয়া লঞ্চ ঘাটে রবিবারও সকাল থেকে যাত্রীদের ভিড় ছিল। দক্ষিণ এবং পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন থেকে আসা ঢাকামুখী যাত্রীদের ঢল নেমেছে। গত শুক্রবার থেকে এই ঘাটে মানুষের ভিড় শুরু হয়েছে। অধিকাংশ মানুষ ঘাটে যানজটে আটকে থাকার ভয়ে ফেরি পারাপারের পরিবর্তে লঞ্চে নদী পাড়ি দিচ্ছেন। প্রতিটি লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ সংখ্যক যাত্রী বহন করছে।
আরিচা লঞ্চ মালিক সমিতি দৌলতদিয়া ঘাট প্রতিনিধি নুরুল আনোয়ার বলেন, গতকাল শনিবার সকাল ৬টা থেকে রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ১৬৬টি লঞ্চ ট্রিপ দিয়েছে। তবে ঝুঁকির কথা ভেবে রাত দশটার পর থেকে লঞ্চে যাত্রী পারাপার অনেকটা বন্ধ থাকায় ট্রিপ সংখ্যা কম রয়েছে, নতুবা আরও অনেক বাড়তো। ২৪ ঘন্টায় প্রায় ৩০ হাজারের মতো যাত্রী পার হয়েছে।
আরও পড়ুন: শিমুলিয়ার পরিবর্তে পাটুরিয়া দিয়ে যান চলাচলের অনুরোধ নৌপ্রতিমন্ত্রীর