‘একদিন আয় না করলে সংসার চলে না, তবুও বাঁচার তাগিদে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে হয়। সব ভেসে গেছে, জিনিসের দাম বেড়েছে। সংসার চালানো নিয়ে চিন্তিত।’ খুলনার কয়রায় স্বেচ্ছাসেবায় রিংবাঁধ নির্মাণ করতে আসা এক উপকূলযোদ্ধা গোপাল সরকার আক্ষেপের সাথে এমনটি জানালেন। তিনি দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের হলুদবুনিয়ায় বসবাস করেন।
দক্ষিণ বেদকাশী গ্রামের চা বিক্রেতা ওবায়দুল হোসেন বলেন, দিন শেষে যে আয় হয় সেটা দিয়ে কোন রকমে তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে কষ্টে দিনতিপাত করি। পানি ওঠায় কয়েক দিন দোকান বন্ধ, প্রতিদিন বাঁধে যেয়ে ফ্রি কাজ করেছি। বাজার করতে পারিনি, খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। তবে বাঁধ মেরামত করতে পেরে তিনি খুঁশি।
এমন আক্ষেপ শুধু ওবায়দুল কিংবা গোপালের নয়, অবহেলিত কয়রার লাখো মানুষের। ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষই নিম্নবিত্ত। কোথাও বাঁধ ভেঙে গেলে টিকে থাকতে স্বেচ্ছাশ্রম নিজেদেরই ঝাপিয়ে পড়তে হয় পানি আটকানোর জন্য।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১৪/১ নম্বর পোল্ডারে কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া, মেদেরচর, ঘড়িলাল বাজার ও চরামুখা এলাকার বাঁধ মেরামতে ৩ কোটি ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। কাজটিতে অর্থায়ন করেছে জাপান আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা (জাইকা)। দরপত্রের মাধ্যমে ‘অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা’ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই কাজটির দায়িত্ব পায়।
প্রতিষ্ঠানটির ঠিকাদার জাকির মোহান্দি। তিনি তার পূর্ব পরিচিত শ্রমিক সর্দার সাতক্ষীরার আক্কাস আলীর কাছে লিখিত চুক্তির মাধ্যমে লাইসেন্স ভাড়া দিয়েছেন। বিষয়টি শ্রমিক আক্কাস আলী স্বীকার করেছেন। বর্তমানে ওই কাজটি তিনিই করছেন। আর স্থানীয়ভাবে কাজ দেখাশুনা করছেন ওই মোজাফ্ফার মেম্বার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বড় কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, সরঞ্জাম ও লোকবল নেই ওই শ্রমিক সর্দারের। কাজের মান ভালো না হওয়ায় চলমান কাজের চরামুখা এলাকার বাঁধ গত ১৭ জুলাই ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দাপ্তরিকভাবে ওই কাজের তদারকির দায়িত্বে আছেন পাউবো’র উপ-সহকারি প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন। তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন।
সরঞ্জাম বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা অফিস থেকেই সব দিয়েছি। যে কোন দোকান থেকে সব আনতে বলি, পরে যে ঠিকাদার কাজ পাবেন তিনি সব পরিশোধ করেন। পরে মোজাফ্ফার মেম্বারের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, তিনি ওখানের কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এজন্য উনাকে দিয়ে করাচ্ছি।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় প্রাথমিকভাবে পানি প্রবেশ রোধ করা গেছে। পাউবো’র পক্ষ থেকে বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য বাঁশ ও জিও ব্যাগ দেয়া হয়েছিল। এবার পাউবো বাঁধ শক্তিশালী করার কাজ করবে।
গত ১৩ আগস্ট জোয়ারের পানির চাপে কপোতাক্ষ নদের চরামূখা নামক স্থানের রিংবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। ওই দিন থেকে টানা পাঁচ দিন স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বুধবার (১৭ আগস্ট) নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। টানা ৪ দিন বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও পঞ্চমদিনে প্রায় ৩ হাজার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমের প্রচেষ্টায় ফের রিংবাঁধ দিয়ে কপোতাক্ষের নোনা পানি আটকাতে সক্ষম হয়েছে। তবে শুধু এবার নয়, প্রতি দুর্যোগের পর এভাবেই ভাঙা বাঁধ মেরামতে স্থানীয় মানুষকেই দায়িত্ব নিতে হয় বলে জানালেন তারা। এবার বাঁশ- সিনথেটিক ব্যাগ চাহিদা মত না পাওয়ায় কাজে চরম ভোগ পেতে হয় বলে অভিযোগ তাদের।
পড়ুন: কয়রায় স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণে সহস্রাধিক মানুষ
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৭ জুলাই ভোরে চরামুখার এই বাঁধের প্রায় ৩০০ মিটারের মতো ধসে যায়। সেসময় ভাঙা স্থানে রিংবাঁধ দিয়ে পানি আটকানো সম্ভব হয়। এরপর ১৩ আগস্ট দুপুরে উচ্চ জোয়ারে ওই রিং বাঁধটি পুনরায় ভেঙে যায়। এই ভাঙনে কপোতাক্ষের নোনা পানিতে ডুবে যায় ১০টির বেশি গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়ে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। অভ্যন্তরিণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, মৎস্য ঘের, আমনের বীজতলা, বসতবাড়িসহ পরিবেশের চরম ক্ষতি হয়েছে।
বাঁধ মেরামতে আসা লোকজন অভিযোগ করেন, চরামুখার বাঁধটি সংস্কারের জন্য কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগিদ দেয়া হলেও তারা এড়িয়ে গেছে। এলাকার জনপ্রতিনিধিদের জানালে এ কাজ তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না বলে জানিয়ে দেন। উপজেলা প্রশাসনও একই কথা জানায়। অথচ বাঁধ ভাঙলে বারবার ভুক্তভোগী মানুষকেই তা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হয়।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা নাজমুল জানান, বাঁধ নির্মাণে কাজ করেছি। চাহিদা অনুযায়ী সরঞ্জামাদি দেয়া হয়নি। মোজাফ্ফার মেম্বার ও এক পাউবো কর্মকর্তার সখ্যতা রয়েছে।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, আমরা দেখেছি বিগত ১০ বছরে জরুরি কাজের নামে কয়রার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১শ’ ৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৮ হাজার টাকারও বেশি। বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ হয় না। সেখানে রয়েছে অর্থ লুটপাটের অসাধু চক্র। টেন্ডারে কাজ পেয়ে মূল ঠিকাদার নিজের লাভটা রেখে কাজটা বিক্রি করে দেন আরেকজনের কাছে। এভাবে হাতবদল হলে কাজের মান খারাপ হতে বাধ্য- এটাই দেখে এসেছি এতদিন।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) দুপুরে চরামুখা গ্রামের খালের গোড়া নামক স্থানে কপোতাক্ষ নদের ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের রিংবাঁধ মেরামত কাজ পরিদর্শন করেছেন খুলনা-৬ আসনের (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবু।
এসময় তিনি বলেন, সরকার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প দিয়েছেন যেটা একনেকে পাশ হয়েছে, এটার টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া জাইকার অর্থায়ানে ৩৫০ কোটি ব্যয়ে বেঁড়িবাধের কাজ চলমান আছে। এছাড়াও বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানসমূহ জরুরি ভিত্তিতে সংস্কারের জন্য মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।