ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন উপজেলায় শুরু হয়েছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘ভাদর কাটানি উৎসব’। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনাকালেও গ্রামের মানুষ এখনও ভোলেনি যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই উৎসবের কথা।
ভাদ্র মাস শুরু না হতেই নববধূদের বাবার বাড়ি নাইওর যাওয়া শুরু হয়। আধুনিকতার যুগে শহরাঞ্চলে এর প্রভাব না থাকলেও গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে উৎসবটি অধিক পরিচিত। শ্রাবণের শেষ দিকেই শুরু হয়েছে এই ভাদর কাটানি উৎসব।
ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে কমপক্ষে ১৫ দিন পর্যন্ত স্বামীর মঙ্গল কামনায় নতুন বউ তার স্বামীর মুখ দর্শন করেন না।
আরও পড়ুন: তুরস্কে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী
ঠাকুরগাঁওয়ের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে বলেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই উৎসবের কোনও ব্যাখা বা যুক্তি না থাকলেও বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষের এটি আদি প্রথা। যা বাপ-দাদাদের আমল থেকে পালিত হয়ে আসছে।
রাণীশংকৈল উপজেলার রাতোর ইউনিয়নের ধামেরহাট গ্রামের তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘আমার বিয়ের এক বছরের মাথায় মায়ের নির্দেশে আমার স্ত্রী বাবার বাড়ি চলে যায়। এটা চিরাচরিত নিয়ম বলে আমার বলার কিছুই ছিল না। প্রায় ১৫-২০ দিন পর সে বাড়িতে আসে। এছাড়াও গ্রামীণ ঐতিহ্য হিসেবে ভাদ্র মাসে মামির হাতে ভাত খেতে হয়। এখনও ভাগ্নেরা মামার বাড়ি গিয়ে মামির হাতে ভাত খায়। কারণ ভাদ্র মাসে নানা ধরনের অসুখ বিসুখ লেগে থাকে। তাই বড়দের মতে, মামির হাতে ভাত খেলে বাকি ১১ মাস ভালো থাকা যায়।’
একই এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ শশী মোহন রায় জানান, উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওসহ ভারতের মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়ি এলাকার বাঙালি সমাজেও এই প্রথা চালু আছে। তিনি বলেন, এই জন্য ভাদ্র মাসে বিয়ের আয়োজন হয় না বললেই চলে।
গ্রামীণ প্রথা অনুযায়ী, যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে এই 'ভাদর কাটানি' উৎসব পালিত হয়ে আসছে। নিয়ম অনুযায়ী মেয়ে পক্ষ শ্রাবণ মাসের সাত দিন বাকি থাকতেই মেয়েকে বাবার বাড়ি নিয়ে আসতে ছেলের বাড়িতে আম, কাঁঠাল, কলা ও তালসহ মিষ্টি (জিলাপি), পায়েস (ক্ষির) নিয়ে যায়। সেই অনুষ্ঠানে ছেলে পক্ষ তাদের সাধ্যমত আপ্যায়ন করে।
আরও পড়ুন: কোলেস্টেরল কমানোর কার্যকরী ঘরোয়া উপায়
বাচোর ইউনিয়নের কাতিহার স্কুলের শিক্ষক ছবি কান্ত রায় জানান, এটি কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। তবে প্রথাটি দীর্ঘদিন ধরে সমাজে চলে আসছে। এক সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এই উৎসব ঘটা করে পালন করতো। আর এই রেওয়াজ বা রীতি বংশানুক্রমে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে প্রভাবিত করে। এক পর্যায়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায় ‘ভাদর কাটানি উৎসব’।
ভাদ্র মাসে বিয়ে না হওয়ায় শ্রাবণেই বিয়ের ধুম পড়ে যায়। যা অনেকটা প্রতিযোগিতার মতো। এরপর পুরো ভাদ্র মাসই বিয়ে বন্ধ থাকে। অনেকেই কুসংস্কার বলে এই নিয়ম থেকে বেড়িয়ে এসেছেন তবে এর সংখ্যা খুবই কম।