মাত্র দুটি ম্যাচ জিততে পারলেই ইতিহাস সৃষ্টি করত বায়ের লেভারকুজেন। ইউরোপীয় ফুটবলে আগে যা কোনো ক্লাব করে দেখাতে পারেনি, সেই সব ‘প্রতিযোগিতায় অপরাজিত মৌসুম’ শেষ করত জার্মানির ক্লাবটি। তবে ইউরোপা লিগের ফাইনালে ৩-০ গোলে হারিয়ে তাদের সে আশার গুড়ে বালি দিয়েছে আতালান্তা।
টানা ৫১ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর ইউরোপা লিগের মতো বড় ট্রফি হাতছাড়া হওয়ার মধ্য দিয়ে লেভারকুজেনের স্বপ্নযাত্রা থেমেছে। মৌসুমজুড়ে দাপটের সঙ্গে খেললেও বুধবার রাতে আতালান্তাকে চ্যালেঞ্জই জানাতে পারেনি শাবি আলোনসোর শিষ্যরা।
তাদের এই হারের পেছনে ভূমিকা ছিল দক্ষতা ও কৌশলগত বেশ কয়েকটি ভুলের। চলুন সেগুলো নিয়ে আলোচনা করি।
১. গোড়ায় গলদ
মাঠে নামার আগেই একাদশ নির্বাচনের কাজটি করতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেন শাবি। ফাইনাল ম্যাচ জিততে দলে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা আর তারুণ্যের যে মেলবন্ধন প্রয়োজন, তার সবই ছিল স্কোয়াডে। কিন্তু শুরুর একাদশে তার প্রয়োগ দেখা যায়নি।
প্যাট্রিক শিকের মতো প্রমাণিত অস্ত্র থাকতেও আক্রমণের চূড়ায় এদিন অভিজ্ঞতায় ও শারীরিক সামর্থ্যে তুলনামূলক দুর্বল আমিন আদলিকে খেলতে নামান শাবি, যা দলটিকে ভুগিয়েছে পুরো ম্যাচজুড়ে। আতালান্তার অভিজ্ঞ ও সামর্থ্যবান ডিফেন্ডারদের সামনে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছে লেভারকুজেন। ফ্রিমপং-গ্রিমালদোরা বারবার বক্সে ক্রস দিলেও কোনোভাবেই তা আদলির কাছে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে গোল করার সম্ভাবনাগুলো মাঠে মারা গেছে।
আরও পড়ুন: লেভারকুজেনের স্বপ্নযাত্রা থামিয়ে প্রথম ইউরোপা লিগ জিতল আতালান্তা
২. হতশ্রী রক্ষণ
মৌসুমের অন্যান্য বড় দলগুলোর বিপক্ষে সাধারণত ৩-৪-৩ বা ৩-৪-২-১ ফর্মেশনে খেলাতে দেখা গেছে শাবিকে। এর ফলে লেভারকুজেনের প্রতিভাবান দুই উইং ব্যাক জেরেমি ফ্রিমপং ও আলেক্স গ্রিমালদো বেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। একদিকে দুই লাইন ধরে বল নিয়ে উপরে গিয়ে ক্রস দিয়েছে। শুধু ফরোয়ার্ডদেরই নয়, একে-অপরকে দিয়েও গোল করিয়েছে বেশ কয়েকটি। আবার মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সময় দুজন অতিরিক্ত মিডফিল্ডারের ভূমিকা পালন করেছেন তারা; ডিফেন্সে তাদের ভূমিকা ছিল তাই। অর্থাৎ মাঠে তারাঅতিরিক্ত ২ খেলোয়াড়ের ভূমিকা পালন করেছেন সবসময়।
তবে এদিন ৩-৪-২-১ ফর্মেশনে খেলালেও গ্রিমালদো মাঝমাঠে আর ফিমপং খেলেছেন রাইট উইঙ্গার হিসেবে। ফলে আতালান্তার ক্ষিপ্র গতির কাউন্টার অ্যাটাকের সময় উপর থেকে ডিফেন্সে নেমে আসতে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন ফ্রিমপং। ফলে তিন ডিফেন্ডারের রক্ষণ দেওয়াল ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে লুকমান-স্কামাক্কারা।
দুর্বল রক্ষণের কারণেই রক্ষণভাগ সামলাতে গিয়ে মাঝমাঠে বলের নিয়ন্ত্রণ হারায় লেভারকুজেন। আর এ কারণেই গোলের তেমন কোনো সুযোগই তৈরি করতে পারেনি পজেশনাল ফুটবল খেলা দলটি।
আরও পড়ুন: কোপা আমেরিকায় চালু হচ্ছে ‘গোলাপি কার্ড’
৩. ম্যাচের গতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা
প্রথম গোল দিয়ে ম্যাচের গতি বাড়িয়ে দেয় আতালান্তা। তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়েই ম্যাচে খেই হারায় লেভারকুজেন।
আতালান্তা যখন দুর্দান্ত গতিতে খেলছে, ঠিক সেই সময় ম্যাচ স্লো করে দিয়ে বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে ধীরে ধীরে গেম ডেভেলপ করার দরকার ছিল শাবির শিষ্যদের। এতে শুরুতেই গোল খেয়ে হকচকিয়ে যাওয়া তরুণ দলটি আস্তে আস্তে আবার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেত। সেইসঙ্গে গতির ফুটবল খেলা আতালান্তার কাছ থেকে গতি কেড়ে নিয়ে তাদের কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারত। এমনকি প্রথম গোল পেলেও হতাশায় ভুগে ভুলও করে বসার সম্ভাবনা ছিল আতালান্তার, আর সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারত লেভারকুজেন। তবে তার কিছুই হয়নি।
আতালান্তার সঙ্গে সঙ্গে তারাও গতিময় ফুটবল খেলতে শুরু করে, আর নিজেদের কমফোর্ট জোনে পেয়ে বুন্দেসলিগা চ্যাম্পিয়নদের ইচ্ছামতো নাকানি-চুবানি দেয় গাস্পেরিনির শিষ্যরা। বারবার লং পাসে বল নিয়ে সেটিকেই কাউন্টার অ্যাটাক বানিয়ে ১ ভি ১-এ লেভারকুজেন ডিফেন্ডারদের কলা দেখিয়েছেন লুকমান; পুরস্কারও পেয়েছে হাতেনাতে। প্রথম গোলের ১৪ মিনিট পরই প্রতিপক্ষের দুই ডিফেন্ডারকে ড্রিবল করে দারুণ দ্বিতীয় গোলটি করেন তিনি। হ্যাট্ট্রিকের গোলটিও ছিল এরই ফসল।
৪. ফাইনাল টাচ
রক্ষণে হতচ্ছাড়া পারফর্ম্যান্স হলেও গোলের সুযোগ তৈরিতে মোটেও পিছিয়ে ছিল না শাবি আলোনসোর দল। তবে ফাইনাল থার্ডে গিয়ে ভুল পাসে বারবার সুযোগ নষ্ট হয়েছে তাদের।
গোলমুখে লেভারকুজেনের ফিনিশিংও ছিল যাচ্ছেতাই। গ্রিমালদো ফাঁকা বল পেয়েও গোলরক্ষককে ফাঁকি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমন ঘটনা ঘটেছে আরও দুটি।
ফাইনাল ম্যাচে জিততে হলে যতটা নির্ভুল খেলতে হয়, হঠাৎ আসা দুয়েকটি সযোগকে যেভাবে কাজে লাগাতে হয়, সেখানে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে লেভারকুজেন। অন্যদিকে, সেই কাজটিই করেছে আতালান্তা; তিনবার সুযোগ পেয়ে তিনবারই গোল করেছে দলটি। ফলে ৩ গোল খেলেও সান্ত্বনা হিসেবে একটি গোলও পরিশোধ করতে পারেনি লেভারকুজেন।
আরও পড়ুন: পর্তুগালের ইউরো স্কোয়াডে ৪১ বছর বয়সী পেপে
৫. আতালান্তার গেগেন প্রেসিং
জার্মানির ফুটবল থেকে উঠে আসা এই কৌশল রপ্ত করে অনেক ম্যানেজারই মাঠে সফল হয়েছে। ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুল, টমাস টুখেলের চেলসি, এমনকি পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনাও গেগেন প্রেসিংয়ের চমৎকার উদাহরণ। সেই কৌশল দিয়েই বাজিমাৎ করেছেন গাস্পেরিনি।
বলের দখল হারানোর সঙ্গে সঙ্গে আতালান্তার খেলোয়াড়রা গেগেন প্রেসিং বা কাউন্টার প্রেসিং করে দিশেহারা করে দিয়েছে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের। ফলে কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই প্রতিপক্ষের পা থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে বল। এর ফলে উপরে এসে খেলতে থাকা লেভারকুজেনের রক্ষণ আলগা হয়ে পড়েছে বারবার।
আসলে কোন কৌশলে খেলাবেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজের শিষ্যদের শক্তি, শারীরিক সামর্থ্য আর অভিজ্ঞতাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন গাস্পেরিনি। সেইসঙ্গে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সামর্থ্য, উচ্চতা আর অভিজ্ঞতার বিচারও করেছেন তিনি। এসবের প্রতিফলন দেখা গেছে মাঠের খেলায়।
অপরদিকে, ইতালির দলটির শক্তি-সামর্থ্য বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছেন শাবি। খেলোয়াড়ি জীবনে রিয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখে শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান সতীর্থদের সঙ্গে খেললেও এসবের প্রভাব কীভাবে মোকাবিলা করবেন তা ঠিকমতো পরিকল্পনায় আনেননি তিনি। তাই তুলনামূলক তরুণ, অনভিজ্ঞ আর দুর্বল দলটিকে একদণ্ড শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দেননি লুকমান-স্কামাক্কা-জাপাকস্তারা।
আরও পড়ুন: র্যাশফোর্ড-হেন্ডারসনকে বাদ দিয়ে ইংল্যান্ডের ইউরো স্কোয়াড ঘোষণা
ফলে সময়ের্ সঙ্গে লেভারকুজেনের পা থেকে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে, সেইসঙ্গে চুপসে গেছে আত্মবিশ্বাসের বেলুন। তাই এদিন আর শেষ বেলায় চমক দেখানোর কথাটা মাথায়ই হয়তো আসেনি তাদের। হয়তো সেই আত্মবিশ্বাসটাই চলে গিয়েছিল ফ্রিমপং-ভিয়ার্টেসদের!
৬. আতালান্তার প্লেয়ার ট্র্যাকিং
আতালান্তার প্রথম ইউরোপা লিগ জয়ের পেছনে যে কৌশলের সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল, তা হচ্ছে দলটির খেলোয়াড়দের প্লেয়ার ট্র্যাকিংয়ের দক্ষতা। যতবারই লেভারকুজেন গেম ডেভেলপ করতে চেয়েছে, ততবারই প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য পরবর্তী পাস ট্র্যাক করেছে আতালান্তা, সফলও হয়েছে বেশিরভাগ সময়। তাই বিপদ তৈরি হওয়ার আগেই তা অঙ্কুরে বিনষ্ট করেছে গাস্পেরিনির শিষ্যরা।
আবার ঠিক সময়ে ফাউল করেও লেভারকুজেনের বেশ কয়েকটি সুযোগ পরিণত হতে দেননি তারা।
পেশাদারত্ব, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার মিশেলে দর্শকদের দাপুটে এক ম্যাচ উপহার দিয়েছে আতালান্তা। যার ফলে ৬১ বছরের শিরোপা খরা কেটে জয়ের আনন্দে গা ভাসিয়েছে দলটির ভক্ত-সমর্থকরা। অন্যদিকে, তীরে এসে তরী ডোবার আক্ষেপে পুড়েছে লেভারকুজেনসহ কোটি ফুটবল ভক্ত।
পরিশেষে, পাঠকদের উদ্দেশে একটি প্রশ্নই শুধু রেখে যেতে চাই- অসংখ্য জয়ের গৌরবেই কি বেখেয়াল হলেন শাবি, যার খেসারত দিতে হলো লেভারকুজেনের খেলোয়াড় ও লাখো ভক্ত-সমর্থকদের?