বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারকে কেবল অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জই না, দেশের বাইরের সমস্যার মুখেও পড়তে হবে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কের অনিশ্চয়তা ও আরকান বিদ্রোহীহের নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমার সীমান্ত—এসব সংকটকে দেশের বাইরের সমস্যা হিসেবে দেখছেন তিনি।
সম্প্রতি মার্কিন প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসির সাউথ এশিয়া ব্রিফে এক লেখায় তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর—সেটা যখনই হোক না কেন—ঢাকার জন্য সবকিছু সহজ হয়ে যাবে; বিষয়টি ঠিক এমন না।’
গেল সপ্তাহ ঢাকায় কাটিয়েছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এই পরিচালক। এক সময় ঢাকার সর্বত্র শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করা হতো। সবকিছুতে তিনি সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন।
সেই কথা উল্লেখ করে কুগেলম্যান লিখেছেন, ‘দেশজুড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এই নেতার প্রচুর ভাস্কর্য ও ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছিল। জনপরিসরে দেওয়া রাজনীতিবিদদের বক্তৃতায় তার নাম সবসময় স্মরণ করা হতো। কিন্তু আজ তাকে কোথাও পাওয়া যায় না, পুরো শহরজুড়ে এখন কেবল জেন জি বিপ্লবীদের স্মরণ করা হচ্ছে।’
আরও পড়ুন: ইউএনজি’র ৭৯তম অধিবেশন ড. ইউনূসের সরকারের জন্য বড় সুযোগ: কুগেলম্যান
ঢাকা সফরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ ক্রমাগত অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন ও শাসন ব্যবস্থায় সংস্কারের উচ্চাভিলাষের অঙ্গীকার করলেও এখন পর্যন্ত তাদের সফলতা উল্লেখ করার মতো না।’
‘জননিরাপত্তার উন্নতি হয়েছে, যদিও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থকদের বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিশোধমূলক সহিংসতা রয়ে গেছে,’ বলেন তিনি।
কুগেলম্যান বলেন, ‘অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এখনো কর্মস্থলে যোগ দেননি। গত বছরের আন্দোলনে উজ্জীবিত অ্যাকটিভিস্টরা বিভিন্ন কারণে এখনো রাস্তায় জড়ো হচ্ছেন—আন্দোলন ও বিক্ষোভ করছেন।’
কিন্তু দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীসহ অনেক বাংলাদেশিকে এখনো উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন এই গবেষক। বাংলাদেশের অর্থনীতি হোঁচট খাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত বছর হাসিনা শাসনের পতনের পর থেকে অর্থনীতির ক্রমাগত অবনতি ঘটছে।’
‘মুদ্রাস্ফীতি কমছে, কিন্তু এখনো সেটা দুই অঙ্কের কাছাকাছি। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল দুই শতাংশের নিচে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরবর্তী তিন মাসে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) একাত্তর শতাংশ কমেছে,’ বলেন এই পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ।
‘এসবের বাইরেও সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে জনগণের কাছে সীমিত তথ্য আছে। যদিও ব্যাংকিং ও সংবিধানসহ বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কী লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে; তা পরিষ্কার না,’ বলেন কুগেলম্যান।
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার বলছে যে এ জন্য সময় লাগবে। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছেন যে দেশের শাসন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে হাসিনা। এখান থেকে বের হওয়ার সহজ রাস্তা নেই।’
জনগণের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ম্যান্ডেটের ঘাটতি এই সরকারকে দুর্বল করে দেবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘গেল আগস্টে নতুন প্রশাসনকে স্বাগত জানিয়েছিল দেশের অধিকাংশ মানুষ। কিন্তু এটা কোনো নির্বাচিত সরকার না। যে কারণে এই সরকার যত দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকবে, ততবেশি নির্বাচন দেওয়ার চাপের মুখে পড়বে।’
‘ঢাকায় যে কয়েকজন লোকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে, সে অনুসারে বলতে পারি, দুটি গোষ্ঠী এখন নির্বাচন দেখতে চাচ্ছে: ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও সামরিক বাহিনী,’ বলেন দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এই গবেষক।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘চলতি বছরের শেষ দিকে কিংবা আগামী বছরের জুনে নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক সময়সীমা ঘোষণা করেনি সরকার।’
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা একটি পরিপূর্ণ সংস্কার চাচ্ছেন—এবং নতুন একটি রাজনৈতিক দল গড়তে তাদের আরও সময় দরকার।’ কুগেলম্যান বলেন, ‘যদি সংস্কার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সময়ক্ষেপণ করে, তাহলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে সবকিছু উল্টে দেবে।’
আরও পড়ুন: বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক ও ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে যুক্তরাষ্ট্র: কুগেলম্যান
‘এসব অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তার মানে এই নয় যে লোকজন হাসিনার প্রতি স্মৃতিকাতর হয়ে যাচ্ছেন; তাদের কাছে অতীতের নিপীড়নের চেয়ে বর্তমান পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার মতো।’
তিনি বলেন, ‘এখনো চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি—বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে—অধরাই রয়ে গেছে, পাশপাশি মানুষের ধৈর্যও কমে যাচ্ছে।