একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সেরে ওঠা রোগীদের পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিস, শ্বাসযন্ত্র ও কার্ডিওভাসকুলার জটিলতার ঝুঁকি বেশি।
মঙ্গলবার আইসিডিডিআর,বি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) যৌথভাবে ‘করোনার দীর্ঘমেয়াদী সিক্যুয়েলা: ঢাকা, বাংলাদেশ এ লংগিটুডিনাল ফলো-আপ স্টাডি’ শীর্ষক একটি প্রচার সেমিনারের আয়োজন করেছে। ‘লং টার্ম সিকুয়েল অব কোভিড-১৯: অ্যা লংগিটুডিনাল ফলোআপ স্টাডি ইন ঢাকা, বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন হয়। এছাড়া সেমিনারে ‘লং কোভিড ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন ফর ফিজিশিয়ানস’ শীর্ষক একটি নির্দেশিকাও উপস্থাপন করা হয়।
আরও পড়ুন: ষাটোর্ধ্বদের করোনা টিকার ৪র্থ ডোজ দেয়া হবে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
গবেষণাটি ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর এর মধ্যে বাংলাদেশের ঢাকার দুটি হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা নেয়া রোগীদের নিয়ে করা হয়েছে।
প্রথম পাঁচ মাসের অংশগ্রহণকারীদের ফলো-আপের ওপর ভিত্তি করে ফলাফলগুলো সম্প্রতি দ্য ল্যানসেট রিজিওনাল হেলথ সাউথইস্ট এশিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের এই গবেষণা কার্যক্রমে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) অ্যালায়েন্স ফর কমব্যাটিং টিবি (এসিটিবি) অর্থায়ন করেছে।
এশিয়ার মধ্যে এটি প্রথম গবেষণা যেখানে দেখা যায়, করোনা থেকে সেরে ওঠা ভোগীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে, যাকে পোস্ট-কোভিড-১৯ সিনড্রোম (পিসিএস) বা লং কোভিড হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
বিএসএমএমইউ’র ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সোহায়েল মাহমুদ আরাফাত, বিএসএমএমইউ’র কার্ডিওলজি বিভাগের প্রফেসর ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদ, এবং আইসিডিডিআরবি’র নিউট্রিশন ও ক্লিনিক্যাল সার্ভি বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী ও প্রধান গবেষক ডা. ফারজানা আফরোজ প্রমুখ গবেষক অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন।
গবেষকরা আরটি-পিসিআর নিশ্চিত করোনা রোগীসহ ১৮ বছরের বেশি বয়সী ৩৬২ জন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করে।
করোনা-পরবর্তী তাদের জটিলতা নির্ণয় করার জন্য সেরে ওঠার ১ মাস, ৩ মাস এবং ৫ মাস পর ফলোআপ করা হয়। তাদের স্নায়ুবিক, হৃদযন্ত্র, শ্বাসযন্ত্র এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এছাড়া গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের ২৪ মাসের জন্য ফলোআপ করা হবে।
গবেষণায় দেখা যায়, ৪০ বছরের কম বয়সীদের তুলনায় ৬০ বছরের বেশি বয়সী সেরে ওঠা ব্যক্তিদের কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদযন্ত্রের জটিলতা (উচ্চ রক্তচাপ দ্রুত হৃদকম্পন বা পা ফুলে যাওয়া) এবং স্নায়ুবিক (পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বা হাত ও পায়ে অসাড়তা, ঝিমঝিম করা বা ব্যথা, স্বাদ ও গন্ধের অস্বাভাবিকতা) জটিলতা সম্ভবনা দ্বিগুণ।
এই রোগের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাবগুলোও নারী পুরুষ ভেদে পৃথক, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে কোডিড-পরবর্তী জটিলতার প্রকোপ দেড় থেকে চার (১.৫-৪) গুণ পর্যন্ত বেশি দেখা গেছে।
আরও পড়ুন: করোনাকালে শিশুদের লেখাপড়ার ওপর ডিজিটাল-বৈষম্যের ভয়াবহ প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে জরিপে: ইউনিসেফ
হাসপাতালে ভর্তিকৃত এবং নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন হয়েছিল এমন রোগীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার সম্ভাবনা হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া রোগীদের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ পর্যন্ত বেশি পাওয়া গেছে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত গুরুতর কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের নিয়মিত ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন করা সত্ত্বেও রক্তে অনিয়ন্ত্রিত শর্করার (ব্লাড সুগার) সম্ভাবনা যাদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়নি তাদের তুলনায় ৯ থেকে ১১ গুণ বেশি ছিল এবং তাই যারা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তাদের বেশি ইনসুলিন প্রয়োজন হয়।
গবেষণায় বলা হয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া রোগীদের নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার ছিল প্রতি এক হাজার জনে ১০ জন। একইভাবে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের মধ্যে নতুন করে কিডনিজনিত জটিলতা (হাই ক্রিয়েটেনিন এবং প্রোটিনিউরিয়া) এবং লিভারজনিত জটিলতা (বর্ধিত লিভার এনজাইন) উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল।
বেশিরভাগ জটিলতা উভয় গ্রুপেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়।
তবে সুস্থ হওয়ার পাঁচ মাস পরেও শ্বাসকষ্ট, হৃদকম্পন, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়নি।
ফলাফলগুলো করোনা থেকে বেঁচে যাওয়াদের ক্রমাগত ফলোআপ এবং যত্নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
বয়স্ক এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের কার্ডিওভাসকুলার জটিলতার জন্য নিয়মিত ফলোআপ করা উচিত।
অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত চিকিৎসকদের জন্য লং-কোভিডের জন্য ক্লিনিকাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন উপস্থাপন করেন।
যা বিএসএসএমইউ ও আইসিডিডিআর,বি যৌথভাবে তৈরি করেছে।
বিএসএমএমইউর ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. শরফুদ্দিন আহমেদ সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি লং-কোভিড জটিলতা বোঝার ও সমাধানের জন্য আইসিডিডিআর,বি ও বিএসএসএমইউ এর বিজ্ঞানীদের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন।
সেমিনারে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক, বিএসএমএমইউ, আইসিডিডিআর,বি এবং গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন: করোনার নতুন উপধরন বিএফ-৭ ঠেকাতে সতর্ক দর্শনা চেকপোস্ট