ভূ-রাজনীতির এই টানাপোড়েনের সময়ে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রেখে দুই দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার বিষয়ে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা।
বৃহস্পতিবার কসমস গ্রুপের জনহিতকর প্রতিষ্ঠান কসমস ফাউন্ডেশন আয়োজিত একটি অনলাইন সংলাপে তারা দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সকল সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার বিষয়ে বাংলাদেশ ও চীনের প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করেন। উভয় দেশের বিশেষজ্ঞরা দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের অবস্থা মূল্যায়ন করেন এবং এই সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগগুলো চিহ্নিত করেন।
আরও পড়ুন: সন্ধান মেলেনি পদ্মায় নিখোঁজ চীনা প্রকৌশলীর
‘বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক: ভবিষৎতের পূর্বাভাস’ শীর্ষক এই সংলাপে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খান। সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত কূটনীতিক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী। আলোচক প্যানেলে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম, সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের এম চৌধুরী, ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী গবেষক ড. জু ইওংমেং, চীনা ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহকারী গবেষণা ফেলো ড. নিং শেংনান, সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর।
আরও পড়ুন: কসমস সেন্টারে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে প্রদর্শনী দেখলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত
সম্পর্ক উন্নয়নে পাঁচ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ চীনা রাষ্ট্রদূতের
বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং মূল বক্তব্যে বলেন, ‘ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে আমরা চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে শক্তিশালী কৌশলগত সহযোগিতার অংশীদারিত্ব প্রত্যাশা করি।’ রাষ্ট্রদূত লি পাঁচটি বিষয় তুলে ধরেন যেখানে বাংলাদেশ ও চীন বর্তমান অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করতে পারে। এগুলো হলো মহামারি রোধে সহযোগিতা আরও বাড়ানো, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে এগিয়ে নেওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা, তাৎক্ষণিক উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করা এবং বহুপাক্ষিকতা বহাল রাখা।
চীনা রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, মহাসচিব শি জিমিংয়ের নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) শিগগিরিই তার শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে। বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী এবং আরও প্রাণবন্ত করতে সিপিসি বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রস্তুত।
আরও পড়ুন: তিন নভোচারী নিয়ে চীনের প্রথম মহাকাশ যাত্রা
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া
উদ্বোধনী বক্তব্যে চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খান চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, এক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান আমাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, ঐতিহাসিকভাবেই রাষ্ট্র দুটির জনগণের মধ্যে যোগাযোগের যে ব্যাপ্তি ও প্রসার রয়েছে তা প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। এ সময় তিনি অনেক আগে তার নেওয়া চীনের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের সাক্ষাৎকারের কথা স্মরণ করেন।
ওয়াং ইয়েকে অন্যতম জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করে এনায়েতুল্লাহ খান বলেন, তিনি (ওয়াং ইয়ে) আমাকে বলেছিলেন, চীনের মূলনীতি হল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক সুশীল এবং উভয় পক্ষের অংশীদাররা এই সম্পর্ককে আরও প্রশস্ত ও গভীর করতে সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা করছেন।
সভাপতির বক্তব্যে ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী চীনের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যন্য রাষ্ট্রের অভূতপূর্ব উত্থানে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, “চীনের উত্থান সম্ভবত সমসাময়িক সময়ের বড় ঘটনা। তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুততম সময়ে প্রথম হতে প্রস্তুত।
ড. চৌধুরী বলেন, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চেয়ে চীনের দৃষ্টি আরও বেশিকিছুর দিকে। ভ্যাকসিন কূটনীতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেটি জানান দিচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতিতে সর্বদাই উদীয়মান শক্তি এবং বর্তমানে এগিয়ে যাওয়াদের মধ্যে দ্বন্দ্বের আশঙ্কা থাকে। তিনি আরও বলেন, বিশ্ব আশা করে যে এ ধরনের সংঘাত এড়ানো যায় এবং শেষ পর্যন্ত বড় শক্তিগুলো যেমন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। চীনের স্বপ্ন বলতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যা বলেছেন তা এভাবেই বাস্তবায়িত হতে পারে।
আরও পড়ুন: ৯৭ ভাগ পণ্য রপ্তানিতে বাণিজ্য সুবিধা দিচ্ছে চীন: বাণিজ্যমন্ত্রী
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাস
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, ‘বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কূটনীতিকে প্রথম প্রতিরক্ষা লাইন হিসাবে এবং বিরোধ নিষ্পত্তির প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ পারস্পরিক লাভজনক এবং বহুপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক রক্ষায় সচেষ্ট। চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ সার্মথ্য এবং সংকল্পের পরিচয় দিয়েছে।’
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বিশ্লেষকরা অবশ্যই এই অঞ্চলের প্রতিযোগিতারত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সর্ম্পকের ওপর দৃষ্টি রাখতে চান। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটিকে একটি স্বাস্থ্যকর বিকাশ হিসাবে দেখছি যা সকলের, বিশেষত সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উপকার করতে পারে।’
যেহেতু রাষ্ট্রদূত লি জিমিং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন তাই শমসের মনে করেন যে বিষয়টি সবার মাথায় রাখা খুব জরুরি। তিনি আরও বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ, এ ক্ষেত্রে আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে। আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে আমরা যোগাযোগ বৃদ্ধিতে বিশ্বাসী। আমরা কেবল দ্বিপক্ষীয়ভাবে নয়, এশীয় প্রশান্ত মহাসগারীয় সীমান্তের ক্ষেত্রেও ঘনিষ্ঠ কৌশলগত অংশীদারিত্বে বিশ্বাসী।’
তিনি রাষ্ট্রদূত লি এর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদকে ভ্যাকসিন আন্তর্জাতিকতায় প্রতিস্থাপন করা উচিত। ‘আমি মনে করি এই বিষয়ে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং একসাথে আমাদের ভূমিকা পালন করতে হবে, কারণ ভাইরাস কমপক্ষে আরও বেশ কিছু সময়ের জন্য থাকবে।’
চীনা বিশেষজ্ঞ ড. জু বলেছেন, ‘সাধারণ লক্ষ্য এবং পারস্পরিক সুবিধার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিজস্বতা অর্জন করেছে।’ তিনি বলেন, ‘বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে আমরা চীনা ও বাংলাদেশিরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মতামত, ভরসাপূর্ণ বন্ধুত্ব ভাগ করে নিয়েছি; যা চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করছে।’ ড. জু আশা প্রকাশ করেন যে সহযোগিতার অভিজ্ঞতা দু'দেশকে আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যাশার সাথে হাতে হাত রেখে ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, চীন-বাংলাদেশের সম্পর্ককে ভূ-রাজনীতির টানাপোড়েনে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেয়া যাবে না, কারণ তাদের দূরদৃষ্টি অনুযায়ী আগামী দিনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও বেশি রাজনৈতিক সম্পর্কে পরিণত হবে। এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের আওতায় কীভাবে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে নিজস্ব ভিত্তিতে রক্ষা করতে পারে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন তিনি। ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, ‘আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য নীতিনির্ধারণের স্বাধীনতা এবং নীতিনির্ধারণের সার্বভৌমত্ব আরও জটিল হবে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের ফলে চীনের অগ্রাধিকারযোগ্য বাজারে প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: গ্যালারি কসমসের মাসব্যাপী ভার্চুয়াল চিত্র প্রদর্শনী ‘দ্য ব্ল্যাক স্টোরি’ শুরু
কূটনৈতিক সর্ম্পকের বাইরে
চীনা বিশেষজ্ঞ ড. নিং শেংনান বলেন, তারা বিশ্বাস করেন যে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ উন্নয়নের মডেল হিসাবে আর্বিভূত হচ্ছে। তিনি বলেন, চীন-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব কেবল তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেই নয়, একই উন্নয়ন ফিলোসফির মধ্যে নিহিত। চীন এবং বাংলাদেশ উভয়ই শ্রমঘন শিল্প থেকে শিল্পায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বায়ন বিরোধী এই শক্তিশালী তরঙ্গের মুখোমুখি হয়ে চীন ও বাংলাদেশের যৌথভাবে বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান করা এবং একে রক্ষা করা প্রয়োজন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম বলেন, এই পূর্বাভাস এমন একটি পথের সন্ধান দিচ্ছে যার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও চীন ভবিষ্যতে চমৎকার সহযোগিতা প্রত্যাশা করতে পারে।
ড. রাশেদ আল তিতুমীর বলেন, প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য কমপক্ষে তিনটি প্রয়োজনীয় শর্ত রয়েছে যা হল: দুই দেশের মধ্যে উৎপাদন নেটওর্য়াক তৈরি, ঝুঁকি-ভাগ করে নেওয়ার ভিত্তিতে বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তির স্থানান্তর।
সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক করিম বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’-বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, মর্যাদা ও আত্মসম্মান অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
বাংলাদেশ-চীন: একই স্বপ্ন দেখে
চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খান তার সমাপনী বক্তব্যে চীনের রোড এবং বেল্ট ইনিশিয়েটিভের কথা উল্লেখ করেন, যা দূর ও নিকটবর্তী দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশাল প্রতিশ্রুতি বহন করে। তিনি বলেন, সারাবিশ্বের মধ্যে চীনের উন্নয়ন বাংলাদেশিদের কাছে গর্ব এবং আনন্দের অন্যতম উৎস। আমরা জানি যে চীনের জনগণের একটি স্বপ্ন আছে; বাংলাদেশের জনগণেরও সেই স্বপ্ন রয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টায় রয়েছি আমরা।