কোনও মামলা ছাড়াই নওগাঁর সুলতানা জেসমিনকে (৪৫) র্যাবের হেফাজতে নেওয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত যে প্রক্রিয়া তা আইনগতভাবে কতটুকু সঠিক ছিল তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেছেন, আটকের পর সুলতানা জেসমিনকে সম্মানজনক জায়গায় (থানা অথবা কার্যালয়ে) নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল কিনা এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া আইনগতভাবে হয়েছে কিনা? তাকে একটা অভিযোগের ভিত্তিতে তুলে নেওয়া র্যাবেরজুরিসডিকশনে (এখতিয়ার) ছিল কিনা?
রাষ্ট্রপক্ষকে আগামী বুধবারের মধ্যে এসব প্রশ্নের জবাব দাখিল করতে বলেছেন। একই সঙ্গে ওইদিন বেলা ২টায় এ ব্যাপারে পরবর্তী শুনানির জন্য ধার্য করেছেন।
এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে করা এক রিটের শুনানিকালে মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতিআহমেদ সোহেলের বেঞ্চ এসব প্রশ্নের জবাব চান।
এর আগে র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু সংক্রান্ত প্রকাশিত খবর গত সোমবার আদালতের নজরে নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ চেয়েছিলেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক।
আরও পড়ুন: নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে মৃত সুলতানার সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তলব হাইকোর্টের
বিষয়টিতে শুনানির পর হেফাজতে ওই নারীর মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কিনা এবং মৃত্যুর কারণ জানতে সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেখতে চান আদালত।
সুলতানা জেসমিনকে আটকের কারণ, স্থান, সময়, হেফাজতে নেওয়ার কারণ, জিজ্ঞাসাবাদ সুনির্দিষ্ট তথ্যও চান আদালত।
আর এসব তথ্য জানাতে রাষ্ট্রপক্ষকে এক দিনের সময় দেওয়া হয়।
আর আদালতের দৃষ্টিতে আনা ওই আইনজীবীকে বলা হয় রিট আবেদন নিয়ে আসতে।
নির্দেশমত গতকাল মঙ্গলবার আদালতে প্রতিবেদন দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। সেখানে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছিল না।
অন্যদিকে, র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর কারণ ও র্যাবের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন ওই আইনজীবী।
সোমবার বেলা আড়াইটায় এ রিটের শুনানি শুরু হয়। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ।
আবেদনের আরজি তুলে ধরে রিটকারী মনোজ কুমার বলেন, ‘এ ঘটনায় কোনো বিষয়ও বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। র্যাব গঠন করা হয়েছিল দাগি চোর-ডাকাত, মাদক চোরাকারবারি ধরতে। এই নারীকে (সুলতানা জেসমিনকে) আটক করা হয় ২২ মার্চ। আর ২৪ মার্চ তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এই আইনে কাউকে গ্রেপ্তারের এখতিয়ার পুলিশের থাকলেও র্যাবের নেই। তাছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুসারে সুলতানা জেসমিনকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হয়নি।'
আরও পড়ুন: নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে ভূমি অফিস সহকারীর মৃত্যু : অভিযোগ পরিবারের
তিনি আরও বলেন, 'কোনও অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতেই র্যাব এ ধরনের বেআইনি ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা আজ অসহায়। র্যাব যাকে ইচ্ছা তাকে তুলে নিয়ে উধাও করে দিচ্ছে। এটি (সুলতানা জেসমিনকে আটক, হেফাজত, জিজ্ঞাসাবাদ) সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে করা হয়েছে। তাছাড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সুলতানা জেসমিনের মাথায় আঘাত থাকার কথা বলেছেন, যা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসেছে। ফলে র্যাবের কর্মকাণ্ড ও নারীর মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন। যে কারণে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে।’
এরপর শুনানিতে আসেন অ্যাটর্নি জেনারেল। নওগাঁ সদর হাসপাতালে চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, সুলতানা জেসমিনের উচ্চ রক্তচাপ ছিল।
সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র তুলে ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘এক ব্যক্তির অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২২ মার্চ ১১ টা ৫০ মিনিটে নওগাঁ সদরের নওজোয়ান মাঠের সামনে থেকে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুসারে সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়। পরে জনসাধারণের সামনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। তার আগে আটক ওই নারীর মোবাইল ফোন থেকে অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্য ও নথি উদ্ধার করা হয়।’
২৪ ঘণ্টার বেশি সময় র্যাব ওই নারীকে আটকে রাখেনি দাবি করে আমিন উদ্দিন বলেন, ‘পুলিশে সোপর্দ করতে থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে আটক নারী অসুস্থ হয়ে পড়লে দুপুর সোয়া ১টায় প্রথমে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তার রক্তচাপ ছিল ৯০/১৬০। এরপর ওইদিন রাত ৯টা ২০ মিনিটে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তিতে রক্তক্ষরণ জনিত সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এটি সম্পূর্ণভাবে ভুল যে, ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ওই নারীকে হেফাজতে রাখা হয়েছে।’
শুনানির এক পর্যায়ে আদালত বলেন, একজন নাগরিক জঘন্য অপরাধী হতে পারে। অত্যন্ত খারাপ কাজ করতে পারে। সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া (প্রসিডিউর) আছে। দিনশেষে আইনগত প্রক্রিয়া অনুযায়ী কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যখন র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করলো তখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনও মামলা ছিল না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে পুলিশ আটক করলেও একটা কথা ছিল। আইনে তাদের ক্ষমতা আছে। কিন্তু র্যাবের কি ওই আইনে সে ক্ষমতা আছে? কথা হচ্ছে র্যাব তাকে উঠিয়ে নিয়েছে, এরপরই তাকে পুলিশে দেবে। কিন্তু এখানে সেটা দেখা যাচ্ছে না। তাকে উঠিয়ে নেওয়ার পর অন্তবর্তী সময়ে যেভাবে ঘটনা ঘটেছে আমাদের উদ্বেগটা সেখানে। পুরো প্রক্রিয়া আইনগতভাবে হয়েছে এবং র্যাবের কি জুরিসডিকশন (এখতিয়ার) ছিল?
আদালত আরও বলেন, সবার মনে প্রশ্ন কারণ এটা বড় করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সবার ধারণা তাকে র্যাবের হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে। এটা একটা হাইপোথিটিক্যাল (অনুমানিক) বিষয়।
এসময় অ্যাটর্নি জেনারেলেএ এম আমিন উদ্দিন বলেন, আগে ময়না তদন্ত রিপোর্ট আসুক। তারপর এটা বোঝা যাবে।
আদালত বলেন, সবার মনে যে প্রশ্ন, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে নাকি অন্য কিছু এটা পরিষ্কার করতে হবে।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে জামাতুল আনসারের প্রশিক্ষক কমান্ডারসহ ৮ জঙ্গি গ্রেপ্তার: র্যাব
এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে কোন অপরাধ করে, তাহলে তার দায় রাষ্ট্র নেবে না।
আদালত এসময় বলেন, কেউ যেন এ ঘটনায় ভিকটিম না হয়। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হয় সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। এই মহিলা একজন সরকারি কর্মচারী।
এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, তাকে আটকের পরই তার মোবাইলের কথোপকথনসহ যাবতীয় তথ্য প্রিন্ট আউট করা হয়েছে। টাকা যে পাঠানো হয়েছে, মোবাইলে তার ছবি রয়েছে, কথোপকথন প্রকাশ পেয়েছে। যখনই এগুলো প্রিন্ট আউট হয়েছে, তখনই তার প্রেসার বেড়ে গেছে।
এ সময় আদালত বলেন, আমাদের প্রধান উদ্বেগ হচ্ছে আইনগত প্রক্রিয়া। এর বাইরে অনুমাননির্ভর বিষয়ে যাবো না। মামলা হবে কি হবে না সেটা রাষ্ট্র ও ভুক্তভোগীর পরিবারের বিষয়।
এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মামলা হবে কি হবে না সেটা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আসলে বোঝা যাবে। আর রিটকারীর যে মূল যুক্তি ২৪ ঘন্টা। এই যুক্তি তো থাকছে না। তদন্ত করতে হলে তো যুক্তি থাকতে হবে।
এসময় রিটকারী মনোজ কুমার ভৌমিক বলেন, পুরো বিষয়টা কতটুকু আইনসঙ্গতভাবে হয়েছে নাকি হয়নি আমি সেটার তদন্ত চাই।
আদালত বলেন, আমরা আইনী পয়েন্টে থাকতে চাই। কোনও মামলা ছাড়াই এভাবে তাকে উঠিয়ে নেওয়ার জুরিসডিকশন র্যাবের আছে কিনা?
এখানে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, র্যাবের আলাদা রেগুলেটরি আইন আছে। সেখানে কোনও ক্ষমতা আছে কিনা দেখতে হবে। এছাড়া তাকে সাড়ে ১০টায় উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং সোয়া ১টায় হাসপাতালে ভর্তি করা হল। হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত র্যাবের হেফাজতে রাখার এখতিয়ার আছে কিনা, একজন মৌখিকভাবে অভিযোগ দিয়েছে, তার ভিত্তিতে তাকে উঠিয়ে নিতে পারে কিনা?
র্যাব বলেছে, সে অপরাদ স্বীকার করেছে, তার কাছ থেকে কিছু ম্যাটেরিয়াল (উপাদান) সংগ্রহ করেছে-এগুলো করতে পারে কিনা? তার মাথায় আঘাতের বিষয়টি পত্রিকায় এসেছে। কিছু পত্রিকায় বলা হয়েছে ২২ তারিখেই ব্রেইন হ্যামারেজ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এখন তার ময়নাতদন্ত হয়েছে। রিপোর্ট আসতে সময় লাগবে। এ অবস্থায় তাকে তুলে নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া সঠিক ছির কিনা। এর পেছনে আইনগত ভিত্তি, ময়নাতদন্ত রিপোর্টসহ তিনটি বিষয় দেখে আদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য আগামী বুধবার বেলা ২টায় সময নির্ধারণ করেন।