মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছবির স্বত্ব (কপিরাইট) কোন ব্যক্তি দাবি করতে পারবেন না, এর স্বত্ব একমাত্র রাষ্ট্রের বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, কেউ কোনো প্রকাশনায় বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ছবি ব্যবহার করতে চাইলে সূত্র উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা দুটি বইয়ের মেধাস্বত্ব চুরি ও গ্রন্থস্বত্ব জালিয়াতির অভিযোগে যমুনা টিভির সিনিয়র রিপোর্টার নাজমুল হোসেনের বিরুদ্ধে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় দেন।
রায়ে বলা হয়, জাতির পিতাকে নিয়ে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ এবং বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন নিয়ে ‘৩০৫৩ দিন’ বইয়ের মেধাস্বত্ব যমুনা টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নাজমুল হোসেনের জার্নি মাল্টিমিডিয়ার হলেও বইয়ে ব্যবহৃত চিত্রকর্ম ও ছবির স্বত্ব প্রকাশনী বা তার নয়। যদি বই দুটির প্রকাশিত সংস্করণে চিত্রকর্ম বা ছবির সূত্র উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা না থাকে, তাহলে সূত্র উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে একটি পৃষ্ঠা যুক্ত করতে হবে। আদালতে রিটকারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী অনিক আর হক। আর সাংবাদিক নাজমুল হোসেনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক।
আরও পড়ুন: নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে বঙ্গবন্ধুর ছবি অন্তর্ভুক্তিতে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ কেন নয়: হাইকোর্ট
রিটকারীর আইনজীবী অনিক আর হক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ছবির ওপর কোনো ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কারো কোনো স্বত্ব থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর ছবির স্বত্ব থাকবে জনগণের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে। কেউ নিজের বলে দাবি করতে পারবে না। যারা বইগুলো এরইমধ্যে পাবলিশ করেছেন, সেগুলো তারা আবার সংগ্রহ করে প্রত্যেকটিতে লিখে দেবেন যে, বইগুলোতে ব্যবহার করা ছবির স্বত্ব প্রকাশকের নয়।
রায়ের পর আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, আজ ঐতিহাসিক যে বিষয়টি হয়েছে, তা হলো বঙ্গবন্ধুর পিকটোরিয়াল এবং ইমেজেস নিয়ে আদেশ। এবং স্বাধীনতার যুদ্ধকালীন ছবি ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ছবি দিয়ে যতগুলো বই প্রকাশ হবে, সেসব ছবির কপিরাইট রাষ্ট্রের থাকবে। এটা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দাবি করতে পারবে না। এ ছবিগুলো দিয়ে যখন বই বের হবে, তখন বইয়ের কপিরাইট ব্যক্তির থাকবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা দুটি বইয়ের কপিরাইট নিয়ে মামলা হয়েছিল। আদালত বলে দিয়েছেন, যেহেতু মুজিববর্ষ উপলক্ষে বইগুলো ছাপানো হয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর মধ্যে যেন বইয়ের কার্যক্রম মন্ত্রণালয় শেষ করে। এরপর যে বইগুলো প্রকাশ হবে, সেগুলোর মধ্যে যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ থাকে, যেখান থেকে ছবিগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে।
জানা যায়, ৬৫ হাজার ৭০০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু কর্নারে’ দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ৩৯টি বই কেনার অনুমতি দেয়া হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেজন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ১৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৭ কোটি টাকায় আটটি বই কেনা হয়। যমুনা টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নাজমুল হোসেনের জার্নি মাল্টিমিডিয়া থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ ও বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন নিয়ে ‘৩০৫৩ দিন’ নামে দুটি বই ১৭ কোটি ৫৭ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টাকায় এবং তার স্ত্রী শারমীনের স্বাধীকা পাবলিশার্স থেকে ‘অমর শেখ রাসেল’ নামে একটি বই তিন কোটি ১৩ লাখ ৩৮ হাজার ৯০০ টাকায় কেনা হয়। সে সময় অভিযোগ ওঠে, ‘অমর শেখ রাসেল’ বইটি প্রকাশে লেখকের অনুমতি নেয়া হয়নি। আর বাকি দুটি বইয়ে স্বত্ব ব্যবহারের যথাযথ প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করা হয়নি। এর মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইটি প্রথম প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ‘৩০৫৩ দিন’ প্রকাশ করেছিল কারা অধিদপ্তর।
‘অমর শেখ রাসেল’ বইটি স্বাধীকা পাবলিশার্স প্রথম প্রকাশ করলেও এর সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য নাসরীন আহমেদকে না জানিয়েই তা প্রকাশ এবং বঙ্গবন্ধু কর্নারে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে গত বছর ৩১ অগাস্ট স্বাধীন অথবা বিচারিক অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এই রিটের প্রাথমিক শুনানির পর গত বছর ২ সেপ্টেম্বর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন।
আদেশে আদালত দুটি বইয়ের মেধাস্বত্ব জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ওই তদন্ত কমিটিতে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হককে রাখা হয়। ওই আদেশের পাশাপাশি বই দুটির মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণ করা হবে না, জানতে চেয়ে রুল দেয়।
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে অ্যালবাম তৈরির কাজ করছি: পাকিস্তানি হাইকমিশনার
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ‘জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড’ ও ‘স্বাধীকা পাবলিশার্স’ এবং সাংবাদিক নাজমুল হোসেনের স্ত্রী শারমীন সুলতানাকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
এর মধ্যে গত বছর ২০ অক্টোবর তদন্ত কমিটি আদালতে প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ এবং ‘৩০৫৩ দিন’ বই দুটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মময় জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই। বই দুটির প্রথম প্রকাশক মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ জেল। পরে প্রকাশক পরিবর্তন করা হয়েছে। তাই এ দুটো বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ জেল এর থাকাই বাঞ্ছনীয় বলে কমিটি মনে করে। ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়, ‘৩০৫৩ দিন ’ বইয়ের স্বত্ব পেতে গত বছর ২৯ জানুয়ারি কারা অধিদপ্তর কপিরাইট অফিসে আবেদন করে। তখন পর্যন্ত আবেদনটি বিচারাধীন ছিল।
এদিকে ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইটির স্বত্ব পেতেও কপিরাইট অফিসে আবেদন করেন বইটির সম্পাদক অমিতাভ দেউরী। তার আবেদনটি গত বছর ৭ অক্টোবর খারিজ করে দেয় কপিরাইট অফিস।
নাজমুল হোসেনের আইনজীবী শাহ মনজুরুল হক, ‘কপিরাইট অফিস কারা অধিদপ্তর ও অমিতাভ দেউরীর আবেদন দুটি খারিজ করেছিলেন। হাইকোর্ট রায়ে কপিরাইট অফিসের সিদ্ধান্তই বহাল রেখেছেন। ফলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বই দুটি শিশুদের কাছে পাঠাতে কোনো জটিলতা থাকছে না। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকাশিত বই দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান এই আইনজীবী।
আরও পড়ুন: পীরগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর মামলার আসামিদের আ’লীগে যোগদান