জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) আগামী অর্থবছরের (২০২৪ অর্থবছর) জন্য দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করেছে। এতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা (বরাদ্দের ২৮ দশমিক ৮৮শতাংশ) বরাদ্দ দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর এনইসি সম্মেলন কক্ষে এনইসি চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এনইসি সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়।
মূল এডিপি বরাদ্দের মধ্যে এক লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা স্থানীয় উৎস থেকে এবং ৯৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া হবে।
সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ১১ হাজার ৬৭৪ দশমিক ০২ কোটি টাকা (স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা থেকে) বরাদ্দ বিবেচনা করে সামগ্রিক এডিপি আকার দুই লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ দশমিক ০২ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
নতুন এডিপিতে মোট প্রকল্পের সংখ্যা এক হাজার ৩০৯টি যার মধ্যে এক হাজার ১১৮টি বিনিয়োগ প্রকল্প, ২২টি জরিপ প্রকল্প, ৮০টি প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রকল্প এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও কর্পোরেশনের ৮৯টি প্রকল্প রয়েছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, বিবিএসের সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে (অর্থবছর) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ছয় দশমিক ০৩ শতাংশে।
এছাড়া চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল মেয়াদে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৫০ দশমিক ৩৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যার ব্যয় হয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ৬৪ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বিদায়ী অর্থবছরে মাথাপিছু আয় টাকায় হিসাব করলে গত বছরের তুলনায় বেড়েছে।
এনইসি সভায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী সব দিক দিয়ে দেশের আত্মসম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সংশ্লিষ্ট সকলকে বলেছেন।
অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এবং বিলাসবহুল মানসিকতা পরিহার করে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট সকলকে সতর্ক থাকতে এবং কঠোরতা বজায় রাখতেও বলেছেন হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে মান্নান বলেন, আমরা খরচ করব কিন্তু যেখানে প্রয়োজন সেখানে খরচ করতে হবে।
মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর এড়াতে নিরুৎসাহিত করেছেন, বিকল্প রপ্তানি বাজার অন্বেষণ করেছেন যেহেতু বছরের পর বছর উৎপাদন এবং রপ্তানিযোগ্য পণ্যের পরিমাণ বেড়েছে।
তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এডিপির আকার বেড়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বিদেশি ঋণ সমর্থিত প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সচিবদের নির্দেশ দেন।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ এসডিজি-৩ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: প্রধানমন্ত্রী
মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আরও প্রকল্প নিয়ে আসার জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা রয়েছে তাদের নির্দেশ দিয়েছেন এবং সাধারণভাবে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে তাদের বাস্তবায়নের গতি ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কঠোরতা অনুসরণে ব্যয় করতে হবে… প্রতিটি পয়সা যেখানে প্রয়োজন সেখানে নিয়ম-কানুন এবং মানুষের কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যয় করা উচিত।’
আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে সরকার জনগণকে সন্তুষ্ট করার প্রকল্প গ্রহণ করবে কি না জানতে চাইলে মান্নান ও আলম উভয়েই বলেন, সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে কাজ করে যাবে।
মান্নান আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী কাজ চালিয়ে যাব... আমরা জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য কাজ করি।’
তিনি বলেন, এডিপি বাস্তবায়নের হার ত্বরান্বিত করতে আগামী বছরেও তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন সফরে বিশ্বব্যাংককে বলেছিলেন যে বাংলাদেশ যদি আরও ঋণ দেয় তাহলে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করবে।
পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, এখন থেকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বৈদেশিক সাহায্যের পরিবর্তে সরাসরি প্রকল্প ঋণ বা সরাসরি প্রকল্প অনুদান শব্দটি ব্যবহার করবেন।
তিনি জানান যে এনইসি এডিপিতে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অধীনে করা বিনিয়োগের প্রতিফলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সত্যজিৎ বলেন, প্রধানমন্ত্রী পিছিয়ে পড়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে এবং এডিপি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো মন্ত্রণালয় আরও প্রকল্প নিয়ে আসতে পারে।
সর্বোচ্চ ১০টি খাতভিত্তিক বরাদ্দ বিবেচনা করে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে প্রায় ৪৪ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা (১৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ) এবং তারপরে শিক্ষা খাতে ২৯ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা (১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ), আবাসন সম্প্রদায় সুবিধা ২৭ হাজার ৪৬ কোটি টাকা (১০ দশমিক ২৮ শতাংশ), স্বাস্থ্য খাতে ১৮ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা (সাত দশমিক ১৮), স্থানীয় সরকার ও গ্রামীণ উন্নয়ন ১৬ হাজার ২০৪ কোটি টাকা (ছয় দশমিক ১৬ শতাংশ), কৃষি খাতে ১০ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা (চার দশমিক ০৭ শতাংশ), পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ আট হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা (তিন দশমিক ৪২ শতাংশ), শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা পাঁচ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা (দুই দশমিক ০৪ শতাংশ) এবং বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি খাতে পাঁচ হাজার ৩২১ কোটি টাকা(দুই দশমিক ০২)।
আরও পড়ুন: ১৯৭৬৪৩ কোটি টাকা সংশোধিত এডিপি এনইসিতে অনুমোদন
২০২৪ অর্থবছরের নতুন এডিপি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১০টি বরাদ্দ গ্রহীতা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলো স্থানীয় সরকার বিভাগ যার ৪০ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা (বরাদ্দের ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশ), সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ৩৪ হাজার ৬২ কোটি টাকা (১২ দশমিক ৯৫ শতাংশ), বিদ্যুৎ বিভাগ, ৩৩ হাজার ৭৭৫কোটি টাকা। (১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ), রেলপথ মন্ত্রণালয় ১৪ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা (পাঁচ দশমিক ৬৯ শতাংশ), ১৪ হাজার ৮৬ কোটি টাকা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১২ হাজার ১৮ কোটি টাকা (চার দশমিক ৫৭ শতাংশ), নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ৯ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা (তিন দশমিক ৬০ শতাংশ) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ১২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা (চার দশমিক ৯৪ শতাংশ), স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ১২ হাজার ২০৯ কোটি টাকা(চার দশমিক ৬৪ শতাংশ), এবং সেতু বিভাগ ৯ হাজার ৬৪ কোটি টাকা(তিন দশমিক ৪৫ শতাংশ)।
নতুন এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রাপ্ত ১০টি প্রকল্প হলো- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি ৯ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে এবং তার পরে মাতারবাড়ি ২*৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপারক্রিটিক্যাল কয়লা চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প ৯ হাজার ৮১ কোটি টাকা, প্রথম সংশোধিত চতুর্থ শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প (পিইডিপি-৪) আট হাজার ৫৮৬ কোটি টাকায়, প্রথম সংশোধিত ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ পাঁচ হাজার ৮৭০ কোটি টাকায়, প্রথম সংশোধিত, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়, প্রথম সংশোধিত প্রকল্প হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, প্রথম পর্যায় পাঁচ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকায়, প্রথম সংশোধিত, ভৌত সম্ভাব্যতা উন্নয়ন (পিএডি) চার হাজার ৬৯৬ কোটি টাকায়, প্রথম সংশোধিত, তিন হাজার ৯১১ কোটি টাকায় ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-১), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্প তিন হাজার ৩৭৭ কোটি টাকায় এবং দ্বিতীয় সংশোধিত ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-৬) তিন হাজার ৪২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে।
আরও পড়ুন: ২,০৭,৫৫০ কোটি টাকার সংশোধিত এডিপি অনুমোদন করেছে এনইসি