২০০৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল বাংলাদেশের কিংবদন্তি ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ুন আহমেদের ‘আমার আছে জল’ সিনেমা। সেখানে ‘নিশাদ’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন। তারপর থেকে গান ও নাটকের মাধ্যমে বেশ কিছুবার দর্শকদের সামনে এলেও বড় পর্দা থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। অবশেষে ১৭ বছরের দীর্ঘ বিরতি ভেঙে ‘নীল জোছনা’ শিরোনামের চলচ্চিত্র দিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য পর্দায় ফিরছেন শাওন।
কেমন হতে যাচ্ছে সিনেমার গল্প, আর এই নির্মাণে শাওনের সঙ্গী হচ্ছেন কারা- চলুন জেনে নেয়া যাক।
বিনোদন জগতে শাওনের পদচারণা
বিনোদন জগতে শাওনের শুরুটা ছিল ১৯৮৯ সালে ইবনে মিজান পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘আলাল দুলাল’-এ শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয়ের মাধ্যমে। সেখানে তিনি অভিনয় করেছিলেন তৎকালীন খ্যাতিমান নায়িকা সুচরিতার ছোটবেলার চরিত্রে। তবে তিনি আলোচনায় আসেন শিশু শিল্পীদের জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা ‘নতুন কুঁড়ি’তে বিজয়ী হওয়ার পর। তার নামের সঙ্গে একাধারে জুড়ে ছিল নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনয়শিল্পী।
আরো পড়ুন: ইতালির ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হলো 'ময়না'
ছোটপর্দায় শাওনের অভিষেক হয় ১৯৯৬ সালের ধারাবাহিক নাটক ‘নক্ষত্রের রাত’-এর মাধ্যমে। ধারাবাহিকটি নির্মাণ করেছিলেন প্রথিতযশা নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদ। ১৯৯৯ সালে তার কালজয়ী ধারাবাহিক ‘আজ রবিবার’-এ শাওনের ‘তিতলি’ চরিত্রটি আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। এরপর থেকে হুমায়ুন আহমেদের নাট্যদলের নিয়মিত একজন হয়ে যান শাওন। সে বছরই রম্য নাটক ‘সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড’-এ মিতু চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
শুধু নাটকেই নয়, প্রখ্যাত নির্মাতার চলচ্চিত্রগুলোতেও সমান বিচরণ ছিল এই মেধাবী তারকার। ২০০০ সালে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় প্রধান নায়িকা ‘কুসুম’-এর ভূমিকায় দেখা যায় শাওনকে। এরপর থেকে ‘দুই দুয়ারী’ (২০০১)-তে ‘তরু’, ‘চন্দ্রকথা’ (২০০৩)-য় ‘চন্দ্র’, এবং ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪) সিনেমার ‘আশালতা’ চরিত্রগুলো দর্শক ও সমালোচক মহলে বেশ সমাদৃত হয়।
২০০৪ সালের দর্শকনন্দিত ধারাবাহিক নাটক ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’তে তিনি ‘পুষ্প’ চরিত্রে অভিনয় করেন।
হুমায়ুন আহমেদের নির্দেশনায় শাওনের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল ২০০৮ সালের ‘আমার আছে জল’, আর সর্বশেষ নাটক ছিল ২০১১ সালের ‘স্বর্ণকলস’।
আরো পড়ুন: কিরণ রাওয়ের ‘লাপাতা লেডিস’ নিয়ে যে কারণে এত আলোচনা
২০১২ সালে হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর পর থেকে তার বেশ কিছু রচনা পরিচালনা করেন শাওন।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ২০১১ সালের নাটক ‘স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ’, ২০১৪ সালের ‘বিভ্রম’, এবং ২০১৬ সালের চলচ্চিত্র ‘কৃষ্ণপক্ষ’। ‘কৃষ্ণপক্ষ’ সিনেমায় ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো’ শিরোনামের গানে কণ্ঠ দেওয়ার সুবাদে তিনি শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন।
‘নীল জোছনা’ সিনেমার কথকতা
সিনেমার গল্প
চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য নির্মিত হয়েছে মোশতাক আহমেদের ‘নীল জোছনার জীবন’ উপন্যাস অবলম্বনে, যেটি মুলত একটি প্যারাসাইকোলজি বিষয়ক কাহিনী নিয়ে রচিত।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র লায়লা, যে অতীত ও ভবিষ্যত দেখতে পারে। আর এই বিষয়টি আতঙ্কিত করে তুলেছে তার স্বামী আমিনকে। কেননা সে জানতে পেরেছে খুব শিগগিরই লায়লার ফাঁসি হতে যাচ্ছে, আর কথাটি বলেছে স্বয়ং লায়লা নিজে। আমিন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না, কেন তার স্ত্রীর ফাঁসি হবে; সে তো কোনো অপরাধ করেনি!
আরো পড়ুন: ঈদুল আজহা ২০২৪ এর বাংলাদেশি সিনেমা
চরম উদ্বিগ্নতার মুহুর্তে তারা শরণাপন্ন হয় মনস্তাত্ত্বিক ড. তরফদারের। গভীর পর্যবেক্ষণে তিনি খেয়াল করেন যে, লায়লা প্রায়ই একটি গান গুনগুন করে। আর এই গানের উৎসটি ডাক্তারকে সন্ধান দেয় এক অদ্ভূত বিমূর্ত জীবনের, যার নাম নীল জোছনা।
লায়লার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার পেছনে এই নীল জোছনাই দায়ী। আবার এই নীল জোছনাই তাকে ফাঁসির দিকে ধাবিত করছে।
ডাক্তার টের পান, লায়লার জীবন প্রবাহ পৃথিবীর আর দশটা মানুষের মত স্বাভাবিক নয়। এরপরও তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন মেয়েটির ভয়াবহ পরিণতির গতিপথ পাল্টানোর জন্য।
আরো পড়ুন: ঈদুল আজহা ২০২৪ এর কিছু চমকপ্রদ বাংলা নাটক
চলচ্চিত্রের নির্মাণ ও কলাকুশলি
৬ বছর আগে ২০১৮ সালের শেষ দিকে সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্রটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ফাখরুল আরেফিন খানের পরিচালনায়। মহামারী করোনাসহ নানা কারণে শুটিংয়ের কাজ বারবার পিছিয়ে যায়। অতঃপর চলতি বছরের মে মাস থেকে সফলভাবে সিনেমাটির শুটিং চলছে।
‘ভুবন মাঝি’, ‘গণ্ডি’ এবং ‘জেকে ১৯৭১’-এর পর ফাখরুল আরেফিন খানের চতুর্থ সিনেমা ‘নীল জোছনা’। এর আগে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘আল বদর’ (২০১১)-এর জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
চলচ্চিত্রে শাওনকে দেখা যাবে শহুরে এক নারীর চরিত্রে। সিনেমার আলাদা চমক হিসেবে থাকছেন পশ্চিমবঙ্গের অভিনেত্রী পাওলি দাম। এছাড়া অন্যান্য অভিনয়শিল্পীরা হলেন- ইন্তেখাব দিনার, তারিক আনাম খান, এস এম নাঈম ও পার্থ বড়ুয়া।
আরো পড়ুন: আসছে তাহসান-মিথিলার ওয়েব সিরিজ ‘বাজি’
ছবির ক্যামেরাম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন রানা দাশগুপ্ত। সাকি ব্যানার্জির সংগীত পরিচালনায় ছবিতে গান থাকবে মোট তিনটি। এগুলোর মধ্যে মৌলিক গান দুটি, যেগুলোর গীতিকার লয়দীপ ও মাহমুদ শাওন।
পরিশেষ
মনস্তাত্ত্বিক গল্পের চলচ্চিত্র দিয়ে শাওনের প্রত্যাবর্তন হুমায়ুন-ভক্তদের জন্য নতুন করে থ্রিলার নির্ভর কাজ দেখার ইন্ধন যোগাচ্ছে। ২১ শতকের প্রথম দশকে বিনোদন জগতের বিভিন্ন অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার মাধ্যমে ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের একটি আলাদা জায়গা তৈরি করেছিলেন শাওন। তবে ‘নীল জোছনা’র মাধ্যমে সেই জনপ্রিয়তার পুনরুত্থান ঘটবে কি না, তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে চলচ্চিত্রটির মুক্তির দিন পর্যন্ত।
তবে ফাখরুল আরেফিন খানের বিগত ভিন্ন ধারার কাজের সুবাদে বাংলাদেশি সিনেমা জগতে নতুন কিছু সংযোজনের সম্ভাবনা তৈরি করছে চলচ্চিত্রটি।