ভিডিও স্ট্রিমিং ম্যানিয়াতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে নতুন এই ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের অবস্থান বেশ পাকাপোক্ত করে নিয়েছে বিঞ্জ। ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোকে বেশ সহজলভ্য করে তুলেছে দেশীয় এই ওটিটি পরিষেবা। এই সুবিধাকে আরও গতিশীল করেছে আন্তর্জাতিক মানের ওয়েব সিরিজগুলোর আঙ্গিকে বাংলা ধারাবাহিকগুলোর নতুন রূপে আবির্ভাব। এই বিবর্তনেরই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হতে চলেছে উদীয়মান পরিচালক ও নাট্যকার ভিকি জাহেদের প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘দ্য সাইলেন্স’। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ওটিটি প্লাটফর্ম বিঞ্জের পর্দায় মুক্তির অপেক্ষায় থাকা এই থ্রিলার সিরিজ নিয়েই আজকের নিবন্ধ।

ভিকি জাহেদ: একজন ভিন্নধর্মী গল্পকথক

মিস্টার টুইস্ট খ্যাত ভিকি জাহেদের জন্ম ১৯৯০ সালের ২৯ আগস্ট রাজধানীতে। জীবনের তিন দশকেই তিনি প্রমাণ করেছেন যে চলচ্চিত্র নির্মাণকে তিনি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। তার পড়াশোনা ছিল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে দক্ষ এক প্রকৌশলী হয়ে উঠবেন এমনটাই ছিল কাম্য।

তবে তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইল থেকে পড়াশোনা শেষ করে সোজা চলে আসেন ভিজুয়াল মিডিয়াতে। ক্যারিয়ারের এই নতুন মোড় নেয়াটা খুব একটা সুখকর ছিল না। নিদেনপক্ষে স্রোতের প্রতিকূলে ক্যারিয়ারের হাল ধরার পাশাপাশি নিজের ও পরিবারের সঙ্গেও অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে।

আরও পড়ুন: চরিত্রটি আমি আড়াই বছর বহন করেছি: ‘গুটি’-তে অভিনয় প্রসঙ্গে বাঁধন

সিনেমা নির্মাণের শুরুটা করেন শর্ট ফিল্মে। বেশ কয়েকটি কাজের পর অবশেষে ২০১৬ সালে শর্ট ফিল্ম 'মোমেন্টস' চলচ্চিত্র জগতের লাইমলাইট পড়ে ২৬ বছর বয়সী ভিকি জাহেদের ওপর। এর জনপ্রিয়তার রেশ ধরে একে একে আরও নির্মিত হয় ‘মায়া’, ‘দেয়েল’, ‘ডার্বিন’, এবং ‘আজ আমার পালা’। এগুলো যে শুধুই তার বিনোদনধর্মী কাজ ছিল তা নয়, এগুলোর মাধ্যমে তিনি নিজেকে যেমন শিখিয়েছেন তেমনি বোঝার চেষ্টা করেছেন তার দর্শকদের।

‘দ্বিতীয় সূচনা’, ‘প্রিয় আদনান’ এবং ‘কায়কোবাদ’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের থ্রিলার জনরাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে থাকেন। অবশেষে ‘চিরকাল আজ’ নাটক এবং ‘পূণর্জন্ম’ ওয়েব ফিল্ম সিরিজ তার কেরিয়ারে এক দীর্ঘ মাইলফলক রচনা করে। বিনোদন জগতের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গে পৃষ্ঠপোষকতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন ভিকি। পুণর্জন্ম-৩ প্রকাশের মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যে ইউটিউবের সর্বাধিক দেখা ভিডিওর মধ্যে একটি হয়ে ওঠে। এমনকি যারা এতদিন ভিকিকে চিনতেন না, তারাও ফিল্মটি দেখে এর প্রথম অংশগুলো দেখতে গিয়েছে।

এখন বাংলাদেশের অপরাধ, থ্রিলার, অতিপ্রাকৃত এবং সাসপেন্স ঘরানার নাটক-সিনেমা মানেই ভিকি জাহেদ। হলিউডে মডার্ন থ্রিলার জনরার জনক আলফ্রেড হিচককের এই একনিষ্ঠ ভক্ত নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি দর্শকদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। সমালোচকদের কাছেও তিনি গল্প বলার ব্যাপারে একদম নির্মম, সোজা-সাপ্টা এবং স্বতঃস্ফূর্ত।

আরও পড়ুন: ওয়েব সিরিজ-২০২২: কনটেন্টের ‘নায়ক’ নির্মাতা

প্রতিবার স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসার সময় প্রথমেই তিনি একটি মাত্র শব্দ নিয়ে চিন্তা শুরু করেন। অতঃপর সেই শব্দকে ঘিরে শুরু হয় থিম কল্পনা, যাকে আরও প্রশস্ত করতে চলতে থাকে গবেষণা। গবেষণালব্ধ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এবার শুরু হয় গল্পের বিকাশ, যেটি গিয়ে শেষ হয় একটি পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্টে। তিনি তার টিম সদস্যদের ঘন ঘন বদলাতে রাজি নন। বরঞ্চ তার দাবি- একটি নির্দিষ্ট দলের সাথে কাজ করা তার কন্টেন্ট নির্মাণের প্রক্রিয়াকে আরও বেশি সহজ করে তোলে।

বিঞ্জ: অনলাইন দুনিয়ায় একুশ শতকের দূর-দর্শন

এই ওটিটি প্ল্যাটফর্মটি রবি অ্যাজিয়াটার চাইল্ড কোম্পানি রেডডট ডিজিটালের একটি সার্ভিস, যেটি যাত্রা শুরু ২০২০ সালে। দেশের বৃহত্তম এই ডিজিটাল বিনোদন প্ল্যাটফর্মটির নির্মাতা তথ্য ও প্রযুক্তি পরিষেবা পরিচালনা প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড। বিঞ্জের বিশেষত্ব হচ্ছে এটি আইপিটিভি (ইন্টারনেট প্রোটোকল টেলিভিশন) এবং ডিজিটাল বিনোদনের পরিষেবাগুলোকে একটিমাত্র অনলাইন স্ট্রিমিং সাইটে একত্রিত করেছে।

গুগল প্লে-স্টোর থেকে অনায়াসেই ডাউনলোড করা যায় এই অ্যাপ্লিকেশন। বাংলাদেশে প্রথম গুগল-প্রত্যায়িত এই অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং পরিষেবাটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন ও টেলিভিশনসহ যেকোনো অ্যানড্রয়েড ডিভাইসে ব্যবহার করা যায়। এমনকি বাড়িতে স্মার্ট টিভি না থাকলেও গ্রাহকরা বিঞ্চের দ্বিপাক্ষিক ডিভাইস ব্যবহার করে পুরো এইচডি টিভির অভিজ্ঞতা নিতে পারেন।

আরও পড়ুন: ওটা সত্যি অভিনয় ছিল না, ছিল মায়ের জন্য আবেগ: ‘কারাগার-২’ প্রসঙ্গে চঞ্চল চৌধুরী

ভিকি জাহেদের ‘দ্য সাইলেন্স’-এর প্রযোজনা টিমে র‍্যাঙ্কস ই-মার্ট ও ভি-ক্রিয়েশন ছাড়াও আছেন বিঞ্জ-এর আহমেদ আরমান সিদ্দিকি, রিজওয়ানা রশিদ অনি ও হাসিবুল হাসান।

দ্য সাইলেন্স: থ্রিলার জনরায় সরব সম্ভাবনা

সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের মাঝে এক অকৃত্রিম ও অমোঘ আকর্ষণ কাজ করে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি। এই আকর্ষণ তাকে এক দিকে যেমন করে তোলে মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষি, অন্যদিকে তেমনি উদাসীন করে তোলে সমস্ত সামাজিক নিয়মের প্রতি। আর আবেগটিই তাকে ঠেলে দেয় অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রীতিকর পরিণতির দিকে। ঠিক যেন কিংবদন্তির অ্যাডাম, ইভ এবং সার্পেন্টের গল্প।

এমনি পটভূমি নিয়ে সিরিজটির গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন ভিকি নিজেই। চিত্রনাট্যে তাকে সঙ্গ দিয়েছেন নাজিম উদ-দৌলা। কাহিনীর কেন্দ্রে বরাবরের মত থাকছেন মেহজাবিন চৌধুরী। তার প্রধান সহশিল্পী হিসেবে থাকবেন এ সময়কার ওয়েব কন্টেন্টগুলোতে ব্যস্ত সময় পার করা শ্যামল মাওলা। আর নতুন চমক নিয়ে হাজির হবে ৯০ দশকের জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী আজিজুল হাকিম ও বিজরি বরকতুল্লাহ।

আরও পড়ুন: ‘পাঠান’ আসবে কী আসবে না!

ওয়েব সিরিজটির সম্পাদনা, ভিজুয়াল ইফেক্টে ও আবহ সঙ্গীতে কাজ করেছেন অর্ণব হাসনাত। অন্যদিকে শব্দ গ্রহণে নিযুক্ত ছিলেন সায়বা তালুকদার। আর্ট ডিরেকশনে মো. রিঙ্কু এবং প্রোডাকশন ডিজাইনের দায়িত্বে ছিলেন আলভিরা তাসনিম।

কিছু দিন আগেই ‘কাজলের দিনরাত্রি’ দুর্দান্ত ভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে দর্শকদের হৃদয়কে, যার রেশ এখনো কাটেনি। আর এরই মধ্যে আগামী ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩ হতে যাচ্ছে এই সাসপেন্সে ভরপুর সিরিজের প্রিমিয়ার। ছয় পর্বের মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলারটি দেখার জন্য ভিকি ভক্তদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী ফেব্রুয়ারির ভ্যালেন্টাইন সপ্তাহ পর্যন্ত।

শেষাংশ

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভিকি জাহেদের প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘সাইলেন্স’ তার অন্যান্য কন্টেন্টগুলোর মতই দেশের প্রচলিত ধারাকে পাশ কাটিয়ে যাবে। দর্শকপ্রিয়তার মাত্রা ছাড়িয়ে নিরেট অনুকরণের চেয়ে বিশ্বমানের নিক্ষুত অ্যাডাপ্টেশনকে তা কতটুকু অনুসরণ করতে পারছে, এখন সেটাই দেখার বিষয়।

আরও পড়ুন: অস্ট্রেলিয়ায় মুক্তি পাচ্ছে আরিফিন শুভর ‘ব্ল্যাক ওয়ার’

বাংলা নাটকের সোনালী দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ার থেকেও সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিবর্তনশীল প্রবাহের সাথে তাল মেলানো। এভাবে নাট্য নির্মাতারা যেখানে থামবেন, সেখান থেকেই আরো দ্রুত গতিতে ছোটা শুরু হবে বিঞ্জের মত বাংলা ওটিটি সেবাগুলোর। আর এতেই সম্পন্ন হবে গুণগত বাংলাদেশি কন্টেন্টের বিশ্ব দরবারে পৌঁছানো।